গ্রামে গ্রামে সুরের ঢেউ 

পদ্মপুরাণ গান পরিবেশন করছেন হাওরাঞ্চলের শিল্পীরা। ছবিটি সিলেট নগরের শিবগঞ্জ এলাকা থেকে তোলা
প্রথম আলো

বর্ষায় হাওর যেন সমুদ্রের রূপ পায়। পানিবন্দী গ্রামগুলো ভাসতে থাকে দ্বীপের মতো। ছয় থেকে সাত মাস মাঠ-ঘাট–জমি ডুবে থাকে পানিতে। হাওরাঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের হাতে অফুরন্ত অবসর। এই অলস সময়ে তাঁরা নির্মল আনন্দে মেতে ওঠেন। শিল্পীদের কণ্ঠে সুরে তোলপাড় হতে থাকে হাওর।

হাওরে এখন ভরা বর্ষা। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া—এই সাত জেলায় বিস্তৃত হাওরাঞ্চল। গ্রামে গ্রামে এখন গানের আসর বা উৎসব। বর্ষা শেষে পানি নামতে শুরু করলে শুরু হবে বোরো ধান রোপণের মৌসুম। তখন আবার কাজ। গান আর উৎসবের আয়োজনে তখন ভাটা পড়বে। এখন বর্ষায় হাওরে চলছে উৎসবের পালা।

হাওরের গ্রামগুলো রাতের বেলা জেগে ওঠে। এই সময়ে ঘটা করে আয়োজন করা হয় যাত্রাগান, বাউলগান, ঢপযাত্রা, কীর্তন, মালজোড়া, পালাগান, কিচ্ছাপাঠ, গাজির গান, গুরমার গান, মুর্শিদি ও ফকিরি গানের আসর। মুগ্ধ নারী-পুরুষ শ্রোতা-দর্শকেরা নির্ঘুম রাত কাটান। ঢুলুঢুলু ঘুমচোখে ছোট ছেলেমেয়েরাও বুঁদ হয়ে থাকে আসরে। আসর শেষে ভোরে ঘুমাতে যায় সবাই। যুগের পর যুগ হাওরবাসীরা এভাবে বর্ষা যাপন করে আসছেন।

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের আবদুর রহমান সিলেট অঞ্চলের বাউলশিল্পী। বয়স ৭০ বছর। তিনি বললেন, হাওর অঞ্চলের গ্রামগুলোতে বর্ষা মৌসুমেই তাঁর ডাক পড়ে বেশি। এবার হাওরে বোরোর ফসল ভালো হওয়ায় গানের আয়োজন হচ্ছে কিছুটা বেশি। একই কথা বললেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার খাগাউড়া গ্রামের ঢপযাত্রাগানের শিল্পী রিবেন তালুকদার। তুলনায় নবীন। বয়স ৪৭ বছর। বললেন, তাঁদের ১৮ সদস্যের ‘জয়বাবা লোকনাথ নাট্য সংঘ’ নামে একটা ঢপযাত্রাগানের পেশাদার দল আছে। বর্ষা উৎসব আর পার্বণে তাঁদের ঢপযাত্রা পরিবেশনের ডাক পড়ে।

আনুষ্ঠানিক আসরের বাইরে শৌখিনভাবেও অনেকে গানের আসর বসান। বর্ষায় অলস সময় কাটাতে গ্রামের কেউ কেউ যাত্রাগান লেখেন, এরপর লোকজন জোগাড় করে তার মঞ্চায়ন করেন। কেউ আবার গান লেখেন। অন্য কেউ তাতে সুর দিয়ে আসর জমিয়ে তোলেন। কেউ আবার দূরদূরান্তের নামীদামি বাউলশিল্পীদের এনে রাতের পর রাত বসান গানের আসর।

শুধু গানই নয়, চলে নৌকাবাইচ, মোরগ লড়াই, লাঠিখেলা, কুস্তি, দাবা প্রতিযোগিতাসহ নানা লোকক্রীড়ার আয়োজন। নৌকাবাইচে যোগ দেন আশপাশের গ্রামের হাজারো মানুষ। কেউ উঠানে মাদুর বিছিয়ে ষোলো ঘুঁটি বা তাস খেলায় মেতে ওঠেন। কিশোর–কিশোরীরা ব্যস্ত থাকে মার্বেল খেলা আর মাটির পুতুল তৈরিতে। এভাবেই দিন কেটে যায় খেলায়। এরপর রাতের নীরবতা ভাঙে বাউলের একতারার সুরে বা গায়কের সুকণ্ঠে। প্রায় রাতেই গ্রামে ঢোল, খোল, করতাল আর বেহালা বাজে।

বর্ষায় গ্রামে গ্রামে আরও পড়ে বিয়ের ধুম। বিয়েতে নেচে–গেয়ে নারীরা মুখর করে তোলেন পুরো গ্রাম। জাতপাত, বৈষম্য আর ভেদাভেদ ভুলে আনন্দযজ্ঞে গা ভাসান হাওরের সব মানুষ। এক গ্রামের নামী শিল্পীর ডাক পড়ে আরেক গ্রামে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা বিয়ে উপলক্ষে টানা কয়েক দিন ধামাইল গান পরিবেশনায় আনন্দমুখর সময় কাটান। মুসলিম বাড়ির বিয়ে আয়োজন করা হয় গীতের। বিয়ে না থাকলে নারীরা অলস সময়ে নকশিকাঁথা সেলাই করে সময় পার করেন।

হাওরাঞ্চলে বর্ষায় নানা উৎসবের পাশাপাশি ধর্মীয় নানা আয়োজন এবং পার্বণেও গানের প্রচলন রয়েছে। এখন শ্রাবণ মাস চলছে। এ মাসের শেষ দিনটিতে পূজিত হবেন মনসা দেবী। এ জন্য মাসের শুরু থেকেই হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে চলছে পদ্মপুরাণ পাঠের আসর। মনসা দেবীকে উপলক্ষ করে প্রতিটি বাড়িতেই এখন পঠিত হচ্ছে পদ্মপুরাণ। আকাশে-বাতাসে ভাসছে নারী-পুরুষের সম্মিলিত সুর। ঘরে ঘরে কুপিবাতি জ্বালিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলছে পদ্মপুরাণ পুঁথিপাঠ।

হাওরের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে এখন পদ্মপুরাণ–এর সুরের ঢেউ আকাশে-বাতাসে উড়ছে বলে মন্তব্য করলেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার সাউধেশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও নাইন্দা গ্রামের বাসিন্দা কৃষ্ণকান্ত তালুকদার। তিনি বললেন, শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে মনসা দেবী পূজিত হন। তবে মাসজুড়েই বিশেষত নারীরা একত্র হয়ে ঘরের দাওয়ায় বা ভেতরে চাটি পেতে গোল হয়ে বসে পদ্মপুরাণ পাঠ করেন। যেদিকে কান পাতবেন, শুধু সুর ভেসে আসবে। 

আসলে হাওর মানেই নানা পরব। বারো মাসে তেরো পার্বণ, এই বহুল প্রচলিত প্রবচন মিথ্যা করে দিয়ে এখানে প্রায় প্রতিদিনই চলে উৎসব-পার্বণ। হাওরের বাতাসে সুর আর পদ উড়ে বেড়ায় পাখির মতো।