হন্তারক দিন

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই নিশ্চিত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়। অংশগ্রহণকারীদের জবানিতে সেসব বিজয়দিনের কাহিনি।

১৯৭১ সালের মাচে৴ অসহযোগ আন্দোলনে এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য দানে আমিনউদ্দিনের ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মাচে৴র অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের উদ্দেশে৵ সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। সেই মিছিলে তাঁরই রচিত স্লোগান ‘দেশের ডাকে দিল সাড়া প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা’সংবলিত ব্যানার নিয়ে ঢাকার রাজপথ পরিক্রম করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ল্যাবরেটরির সহকর্মী ও বন্ধুদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করতেন; কারণ, জামায়াতিদের দৃষ্টি থেকে তিনি চাঁদাদাতাদের নিরাপদে রাখতে চাইতেন। অথচ নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।...

১৪ ডিসেম্বর ভোর থেকেই আমি জরুরি প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস একটি বাক্সে ভরে বারবার তাঁকে বাসা ছেড়ে সপরিবার অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলাম, কিন্তু আমার ভাই মঞ্জু তাঁকে বাধা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমাদের আর সায়েন্স ল্যাবরেটরি কলোনি ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। আমার স্বামীরও অবশ্য বাসা ছেড়ে পালানোর ব্যাপারে দোদুল্যমানতা ছিল।

ওই দিনই তাঁর সঙ্গে একই সময়ে অপহৃত ড. সিদ্দিক আহমদও আলবদরদের নৃশংসতা সম্বন্ধে আঁচ করতে পারেননি; ঘাতকদের হানা দেওয়ার কিছুক্ষণ আগেও তিনি অন্য সিঁড়ির বাসা থেকে ছাদ-পথে পালিয়ে এসে আমার স্বামীকে বলেছিলেন, ‘ভয়ের কিছু নেই—আমরা জয়ী হবই।’ এমনই এক ত্রাসের মধে৵ সেদিন ভোর থেকে অনিশ্চিত ও উদ্বেগাকুল সময় অতিবাহিত হচ্ছিল।

বাইরে তখন প্রচণ্ড আকাশযুদ্ধ। কারফিউবন্দী ভীতসন্ত্রস্ত কলোনিবাসীর অসহায়ের মতো মুহূর্ত গোনা ছাড়া উপায় ছিল না। সেই দুর্যোগের মধে৵ সকাল সোয়া আটটার দিকে আততায়ীরা কলোনিতে এল একটা জিপে চেপে। হাতে তাদের নামের তালিকা। পাশবিক উল্লাসে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে নেকড়ের ক্ষিপ্রতায় খুঁজতে লাগল তারা ড. আমিনউদ্দিন, ড. সিদ্দিক আহমদ ও শামসুল আলমকে। কেউ যে আরেকজনকে সতর্ক করে দেবে, কারফিউর জন্য সে সুযোগ ছিল না। সেই সময় আমার স্বামী আমাদের আড়াই মাসের একমাত্র পুত্রসন্তান আয়নের মুখে দুধের ফিডার ধরে রেখেছিলেন; আমি ছিলাম রান্নাঘরে।

সাড়ে আটটার সময় নরপিশাচরা আঘাত করল বাসার প্রবেশদ্বারে। মঞ্জু দরজা খুলতে গেলে তিনি বাধা দিয়ে বললেন, ‘মঞ্জু, তুমি যেয়ো না। আমার বাসা থেকে তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে দিতে পারি না আমি।’

তিনি নিজেই দরজা খুললেন। কালো মুখোশধারী চারজন যুবক রাইফেল হাতে ড. আমিনউদ্দিনের পরিচয় জেনেই ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপর। আমি স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। মঞ্জুর সঙ্গে একটু কথা-কাটাকাটি হতেই তাঁকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে কাঁধে আঘাত করল এক মুখোশধারী। তারপর রাইফেলের নলের মুখে আমার স্বামীকে তাঁরই গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে টেনে বের করে নিয়ে গেল নরপিশাচরা। সে সময় একজন মুখোশধারী আমাকে বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই বোন, এক ঘণ্টা পরেই আপনার স্বামীকে ফেরত দিয়ে যাব।’ আমি এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারিনি। আমার স্বামীকে চোখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে রাইফেলের মুখে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

আমার আশঙ্কা অমূলক ছিল না; আমি স্বামীকে আর ফিরে পাইনি। হানাদারদের দ্বারা অপহৃত অনেক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর মতো আমার স্বামীর লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সূত্র: স্মৃতি: ১৯৭১, প্রথম খণ্ড, সম্পাদক: রশীদ হায়দার, বাংলা একাডেমি, জুন ২০১৭

সুরাইয়া আমিন: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী সায়েন্স ল্যাবরেটরির ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা ড. আমিনউদ্দিনের স্ত্রী