সড়কে অবরোধ, যানবাহন আটকা, পায়ে হেঁটে চলেছে মানুষ
শিক্ষার্থীদের চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে একপর্যায়ে মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে দনিয়া এলাকার টোল প্লাজায় আগুন দেওয়া হয়েছিল গতকাল বুধবার রাতে। তার পর থেকেই উড়াল সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ। দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল থেকে সড়কপথে রাজধানীতে প্রবেশের প্রধান মুখটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাত্রাবাড়ী থেকে সাইনবোর্ড হয়ে প্রায় চিটাগাং রোড পর্যন্ত এলাকার সড়কটিতে কিলোমিটারের পর কিলোমিটারজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে যাত্রীরা গাড়ির ভেতরে আটকা পড়ে থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যারিকেড
সরেজমিন যাত্রাবাড়ী-সাইনবোর্ড এলাকার অবস্থা দেখার জন্য আজ বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ছয়টায় ধানমন্ডি থেকে নিউমার্কেট হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত এলাকার তোরণে পৌঁছানো গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের ফটকে লোহার ব্যারিকেড। পুলিশের সঙ্গে বিজিবি, আর্মড পুলিশ, র্যাব সবাই আছে পাহারায়। ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেল গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র দেখিয়ে। মোটরসাইকেলে পুরো ক্যাম্পাসে চক্কর দিয়ে ছাত্রদের কাউকে দেখা গেল না। কয়েকজন শিক্ষক বেরিয়েছিলেন প্রাতভ্রমণে। উপাচার্যের বাড়ির সামনে, টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে দলবদ্ধ হয়েছিলেন বিভিন্ন বাহিনীর নিরাপত্তারক্ষীরা। দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রবেশমুখের সামনেই ব্যারিকেড দিয়ে রাখা।
ফাঁকা শহর
রাজধানীজুড়ে তখনো কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়নি। পথে কিছু রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল ছাড়া বিশেষ কোনো যানবাহন চোখে পড়ল না। দোকানপাট সবই প্রায় বন্ধ। চানখাঁরপুলের পাশ দিয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে নিচের সড়ক দিয়ে সোজা একটানে সায়েদাবাদ পর্যন্ত আসা গেল অনায়াসে। যাত্রাবাড়ী মোড়ে কিছু ট্রাফিক পুলিশসহ টহল পুলিশকে কর্তব্যরত দেখা গেল। টার্মিনালের ভেতরে বাসগুলো থামিয়ে রাখা। কিছু কিছু বাস আছে সড়কের দুই পাশে লাইন দিয়ে। লোক চলাচল ক্রমেই বাড়ছিল। এখানে কিছু সময় অপেক্ষা করে বাসশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সামনে সড়ক বন্ধ। তাই রাত থেকেই সায়েদাবাদ থেকে বাস চলাচল করছে না।
পোড়া টোল প্লাজা
যাত্রাবাড়ী থেকে পূর্ব দিকের সড়কে বাঁ পাশের লেনটি বন্ধ। কয়েক শ বাস, ট্রাক থেমে আছে। উল্টো পাশের অর্থাৎ ঢাকায় প্রবেশের ডান পাশের সড়কটি ফাঁকা। সেদিক দিয়েই টোল প্লাজার দিকে এগিয়ে যেত যেত দেখা গেল, খানিক পর পর সড়কের ওপরে টায়ার, বাঁশ, কাঠের টুকরা জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। সড়কের কিনার দিয়ে নানা বয়সের শত শত নারী-পুরুষ পায়ে হেঁটে শহরের দিকে যাচ্ছেন।
উড়াল সড়কের টোল প্লাজাটি দনিয়ার সামনে। দনিয়া কলেজের সামনে স্থানীয় বাসিন্দা হুমায়ুন কবির জানালেন, সন্ধ্যায় টোল প্লাজায় হামলা করে আগুন দেওয়া হয়। কে বা কারা হামলা করেছে, তা জানেন না। পোড়া টোল প্লাজার সামনে গিয়ে দেখা গেল, টোল আদায়ের পাঁচটি বুথেই ভাঙচুর করা হয়েছে। তছনছ অবস্থা। আগুনে ওপরের ছাউনি পুড়ে গেছে। সড়ক বিভাজকে রাখা ফুলগাছের টবগুলো সড়কের ওপর ছত্রখান হয়ে আছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে পোড়া গন্ধে। টোল প্লাজার কাছে কোনো লোকজন বা পুলিশ, কাউকেই দেখা যায়নি।
পায়ে হাঁটা জনস্রোত
কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পায়ে হেঁটে আসছিলেন অসংখ্য মানুষ। তাঁদের অনেকে ছিলেন বাসযাত্রী। পিঠে ব্যাগ নিয়ে হাঁটছিলেন আবদুল আউয়াল। তিনি ফেনির শিশু-কিশোর একাডেমি স্কুলের শিক্ষক। সকাল আটটায় দনিয়া এলাকায় কথা হলো তাঁর সঙ্গে। আজ ঢাকায় তাঁর প্রশিক্ষণ ছিল। ফার্মগেটে যাবেন। গতকাল রাত ১১টায় বাসে উঠেছিলেন। যানজটে ধীরগতি ছিল। রাত আনুমানিক চারটার দিকে সাইনবোর্ড এলাকায় এসে গাড়ি আর যেতে পারেনি। অগত্যা সকাল সাতটায় তিনি গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হাঁটা শুরু করেছেন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসযাত্রীদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিলেন আশপাশের চাকরিজীবী বাসিন্দারা। মাজহারুল ইসলাম ও দেলোয়ার হোসেনের বাড়ি সোনারগাঁওয়ের মগড়াপাড়ায়। তাঁরা গ্রিন রোডের বাংলাদেশ হোটেল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের চাকুরে। সকাল ৯টায় তাঁদের অফিস। আগের রাতেই খবর পেয়েছিলেন যানবাহন চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। তাই ভোর সাড়ে পাঁচটায় রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোতে চড়ে সাইনবোর্ড পর্যন্ত এসেছেন। এতেই সকাল আটটা বেজে গেছে। এরপর হাঁটতে শুরু করেছেন তাঁরা। কড়া রোদ উঠেছে। ঘামে ভিজে জবজবে অবস্থা।
মাতুয়াইল এলাকায় দেখা হলো চাঁদপুরের ভবেরচর এলাকার এনআরসি ব্যাংকের চাকরিজীবী মো. আবু সাঈদের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সায়েদাবাদ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে এসেছেন। কোনো যানবাহন পাচ্ছেন না। কত দূর এভাবে যেতে হবে, কোনো ঠিক নেই।
কলকাতার যাত্রীরা রায়েরবাগে
শনির আখড়ার কাছে রায়েরবাগ এলাকার এক ফিলিং স্টেশনের সামনে আটেক আছে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতাগামী শ্যামলী পরিবহনের বাস। নারী যাত্রীদের কেউ কেউ বাস থেকে নেমে জ্বালানি দেওয়ার যন্ত্রের পাশে বসে আছেন। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন যাত্রী উত্তম দে ও দিপু বিশ্বাস। তাঁরা জানালেন, গতকাল বিকেল সাড়ে চারটায় তাঁদের গাড়ি ছেড়েছে চট্টগ্রাম থেকে। রাত ১২টায় তাঁরা সোনারগাঁ পর্যন্ত আসতে পেরেছিলেন। তারপর একটু একটু করে রাত চারটার দিকে শনির আখড়ায় এসে গাড়ি একেবারে থেমে গেছে। তাঁরা কলকাতা যাচ্ছিলেন চিকিৎসার জন্য। আজ বেলা একটায় তাঁদের কলকাতা পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তাঁরা রায়েরবাগেই আটকে ছিলেন।
দনিয়ায় ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড ও হামলা
দনিয়া ওভারব্রিজের সামনে গিয়ে দেখা গেল, সড়কের ডান পাশে আড়াআড়িভাবে ট্রাক দিয়ে সড়ক বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কিছু দূর পরপর সড়কের ওপর আগুন জ্বালানো হচ্ছে। এই পুরো এলাকায় কোনো পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষী কাউকে দেখা যায়নি। সকাল ৯টা থেকেই খানিক পর পর সড়কে কিছু কিছু যুবককে সড়ক অবরোধ করতে দেখা গেছে। তবে তাঁরা পথিক বা রিকশাভ্যানে করে যাওয়া লোকদের চলে যেতে দিয়েছেন। কিন্তু দনিয়ার পর থেকে মাতুয়াইল, মদনপুর, সানারপাড়া এসব এলাকায় অনেককে দেখে ছাত্র মনে হয়নি। আর সড়কে থেমে থাকা বাস-ট্রাকের কিছু শ্রমিকও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তাঁদের অনেকেই লাঠিসোঁটা নিয়ে রিকশা ও ভ্যানের ওপর হামলা করে যাত্রীদের নামিয়ে দেন। মোটরসাইকেল চালকদের ওপর হামলা করে ভাঙচুর করেন। এ সময় সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা এই প্রতিবেদকের মোটারসাইকেলেও ভাঙচুর করেন। ‘কিসের সাংবাদিক’, ‘সাংবাদিক তো কি হইছে’ এমন উক্তি করে তাঁরা পরিচয়পত্র কেড়ে নিয়ে দুমড়েমুচড়ে দেন। পরে আশপাশের লোকের সহায়তায় হামলাকারীদের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে দ্রুত চলে আসতে হয়েছিল।
রাজপথ উত্তাল
সাইনবোর্ড মোড়ে গিয়ে দেখা গেল, শত শত মানুষ যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিছু কিছু রিকশাভ্যান, ব্যাটারিচালিত রিকশা সকাল ৯টা পর্যন্ত চলাচল করলেও ক্রমেই তা বন্ধ হয়ে যায়। সকাল ১০টার দিক থেকে সড়ক উত্তাল হয়ে ওঠে। কিছু দূর পরপরই ব্যারিকেড দেওয়া হয়। সানারপাড়ের পরে আর এগোনো সম্ভব হয়নি।