নীল চাষে সামান্যতম আপত্তি করলেই চাষিদের প্রথমে বেত্রাঘাত, এরপর মাথার ওপর কাদা দিয়ে নীলের বীজ বুনে দেওয়া হতো। চারা না গজানো পর্যন্ত তা মাথা থেকে নামানো হতো না। এতেও কোনো কাজ না হলে তাঁদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হতো। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হতো বাড়িঘর।
এমন পরিস্থিতিতে অনন্যোপায় হয়ে সংঘবদ্ধ হতে থাকেন নীলচাষিরা। নেতৃত্বে আসেন নবাবি আমলে পত্তনি পাওয়া ও ক্ষয়িষ্ণু জমিদার চৌধুরী বংশের উত্তর পুরুষ দিয়ানতুল্লাহ চৌধুরী। পরপর দুবার তিনি কৃষকদের সংগঠিত করে রামচন্দ্রপুর হাটের (সদর উপজেলার মহারাজপুর গ্রামে অবস্থিত) নীলকুঠি আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। লোক ক্ষয় হয়, বিদ্রোহেও ভাটা পড়ে। এরপর ১৮৫৯-৬১ সালে দেশব্যাপী যে নীল বিদ্রোহ হয়েছিল, এর জোয়ার এসে পৌঁছেছিল রামচন্দ্রপুরের বিদ্রোহীদের কাছেও। দিয়ানতুল্লাহ চৌধুরী আবার সংগঠিত করেন কৃষকদের। আবার আক্রমণ করেন রামচন্দ্রপুরের নীলকুঠি। জয় হয় বিদ্রোহীদের। সাময়িকভাবে পরাজিত হয়ে ইংরেজ সাহেব সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে যান। কিন্তু তাঁর স্ত্রী পালানোর সুযোগ না পেয়ে দিয়ানতুল্লাহ চৌধুরীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। মুহূর্তেই দিয়ানতুল্লাহ ঘোড়া থেকে নেমে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাহেবের স্ত্রীর ওপর। ধারালো ছোরা দিয়ে ওই নারীর বুক চিরে দেন। মৃত্যুর আগে মেমসাহেব দিয়ানতুল্লাহকে আসামি করে জবানবন্দি দিয়ে যান। এরপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে তিনি এলাকার বেতবাড়িয়ার জঙ্গলে আত্মগোপন করেন।
ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ধরার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। এরপর দিয়ানতুল্লাহ চৌধুরীসহ ১২ জন বিদ্রোহী ব্রিটিশ শাসনের চক্ষু এড়িয়ে মাঝেমধ্যে নীলকুঠির ওপর ছোটখাটো আক্রমণ চালাতেন। এভাবে তিনি ওই জঙ্গলে ১২ বছর লুকিয়ে (আত্মগোপন) ছিলেন। এ জন্য এলাকার মানুষ তাঁর নাম দেন ‘লুকা চৌধুরী’। হারিয়ে যায় তাঁর প্রকৃত নাম।
আন্দোলন–সংগ্রামে চাঁপাইনবাবগঞ্জ গ্রন্থে মাযহারুল ইসলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জে নীল বিদ্রোহের নায়ক দিয়ানতুল্লাহকে নিয়ে এমনটাই লিখেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাস–ঐতিহ্যসহ একাধিক গবেষণামূলক গ্রন্থের এই লেখক এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ।
এরও আগে ওহাবি আন্দোলনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের অংশগ্রহণের কথাও অনেকের অজানা। এমন সব আন্দোলন-সংগ্রাম, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আঞ্চলিক ইতিহাসে সমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ইতিহাসের এসব উপাদান সাজিয়ে তা সংরক্ষণের কাজটি হাতে নিয়েছে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ। কলেজের দুটি কক্ষে গড়ে তোলা হয়েছে ‘আঞ্চলিক ইতিহাস সংগ্রহশালা’।
ওই সংগ্রহশালায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর লেখা ১২টি চিঠি। এগুলোর মধ্যে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা, স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জননেতা মাওলানা ভাসানীসহ জনতার উদ্দেশে লেখা চিঠি উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় বিভিন্ন বধ্যভূমির আলোকচিত্র ও মৃত্তিকা, বাংলাদেশের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড, শহীদ পরিবারকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি ও চেকের প্রতিলিপি, বঙ্গবন্ধুর অ্যালবাম, বিভিন্ন জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বরেণ্য গবেষকদের লেখা ইতিহাসগ্রন্থ, এনসাইক্লোপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, ফোকলোর গ্রন্থসহ অসংখ্য দুঃপ্রাপ্য হাজারের বেশি বইয়ের সংগ্রহ।
রয়েছে ভাষা আন্দোলনের, মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জেলার সন্তানদের আলোকচিত্র ও পরিচিতি।
অতিসম্প্রতি সংগ্রহশালাটি পরিদর্শন করেন দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মফিদুল হক। তিনি পরিদর্শন বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হলাম। কলেজে জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে স্থানীয় গৌরবময় ইতিহাস যুক্ত করে এক মালায় গেঁথে যে উপস্থাপনা, তা নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে। এখানেই আমাদের আশার জায়গা। এই কাজের যাঁরা কান্ডারি, তাঁদের জানাই অভিবাদন।’
কলেজে আঞ্চলিক ইতিহাস সংগ্রহশালার উদ্বোধন করা হয় ২০১৮ সালের বিজয় দিবসের দিনে। সংগ্রহশালার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম, যিনি একজন ফোকলোর গবেষক ও বহু গ্রন্থের লেখক। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তৎকালীন অধ্যক্ষ শংকর কুমার কুণ্ডু।
মাযহারুল ইসলাম বলেন, ‘সংগ্রশালায় ২০টি চেয়ার রয়েছে বসে পড়ার জন্য। রয়েছে ১৬টি কম্পিউটার। কম্পিউটারে মুক্তিযুদ্ধের গান শোনা ও সিনেমা দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের হাতে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপির সফটকপি। সেটিও বসে দেখার সুযোগ রয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করছি। তাঁরা যেন সংগ্রহশালায় এসে সময় কাটায়। ইচ্ছে আছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের নিদর্শন, প্রকাশনা, চিঠি ও বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহসহ আরও নানা উপাদানে সংগ্রহশালাটি সমৃদ্ধ করার।’
স্থানীয় সুধীজনের আশা, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের সংগ্রহশালা দিনে দিনে এই অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের কেন্দ্র হয়ে উঠবে।