দক্ষিণ-পশ্চিমে বুক চিতিয়ে সুন্দরবন; দক্ষিণ-পূর্বে পাহাড়-জঙ্গলের দেয়াল—এই দুই অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে সমুদ্রের ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে। কিন্তু মাঝখানটায়, মানে নোয়াখালী উপকূলে সে রকম কিছু না থাকায় সামুদ্রিক দুর্যোগের মুখে বিশাল এক জনপদ বরাবরই থেকে গেছে অরক্ষিত। গত শতকের চল্লিশের দশকে হাতিয়ার পাশে বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠে বড় একটা চর। ষাটের দশকের প্রথম দিকে তখনকার সরকারের সিদ্ধান্তে ওই চরে শুরু হয় কৃত্রিম বন তৈরির কাজ। কেওড়া, গেওয়া, বাইন, কাঁকড়ার মতো শ্বাসমূলীয় গাছ লাগানো হয় হাজারে হাজার। একসময় দাঁড়িয়েও যায় গাছগুলো, গড়ে ওঠে আরেকটি ‘সুন্দরবন’। পরে যার নাম হয় নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান। জলবায়ু-ঝুঁকিগ্রস্তদের বুক পেতে রক্ষার স্বপ্ন জাগায় সেই বন।
কিন্তু একসময় মানুষের হাতেই নিধন হতে থাকে মানুষেরই তৈরি শ্বাসমূলীয় সেই বন। নেপথ্যে থেকে ইন্ধন জোগায় ভোটসন্ধানী বিভিন্ন দলীয় সরকার।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, নিঝুম দ্বীপে একদিকে শুরু করা হয় ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরোপণ; অন্যদিকে ভূমিহীনদের বসতি গড়ার জন্য দেওয়া হয় জমি বন্দোবস্ত; শুরু হয় বন উজাড় করে বসতবাড়ি, ফসলের মাঠ তৈরির উৎসব। আবার নিঝুম দ্বীপের ৯ হাজার ৫৫০ একর বনভূমিকে ২০০১ সালে ঘোষণা করা হয় জাতীয় উদ্যান ও কিছু অংশকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তার পর থেকেই বন উজাড় হয় সবচেয়ে বেশি। ২০০৮ সালে দ্বীপটিকে যখন ঘোষণা করা হয় ইউনিয়ন পরিষদ, তখন এর নয়টি ওয়ার্ডের বেশির ভাগেরই অবস্থান হয় জাতীয় উদ্যানের চৌহদ্দির ভেতরে। এভাবে উদ্যানের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে থাকে। অথচ জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনের আইন অনুসারে, এগুলোতে বসতবাড়ি-চাষাবাদ দূরের কথা, বনের গাছের পাতা ছেঁড়া, এমনকি ছাল-বাকল তোলাও অপরাধ।
২০২১ সালে এনভায়রনমেন্টাল চ্যালেঞ্জেস জার্নাল–এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯০ সালে নিঝুম দ্বীপে বনাঞ্চল ছিল ১০ হাজার ৪২২ একর। ২০ বছর পর ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ২১ একরে। আর নিধন হওয়া ৪ হাজার ৪০১ একর বনাঞ্চল বসতবাড়ি ও আবাদি জমিতে রূপান্তরিত হয়, যা অবশিষ্ট বনভূমির ৪২ শতাংশ। অবশ্য ২০২০ সাল পর্যন্ত আবার ৭৫০ একর বনভূমি বেড়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
একই বছর গ্লোবাল জার্নাল অব হিউম্যান-সোশ্যাল সায়েন্স-এ প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় দেখানো হয়, নিঝুম দ্বীপের বন সবচেয়ে বেশি নিধন হয়েছে ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে।
নিঝুম দ্বীপ মানুষের বুকে আশা জাগিয়েছিল, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ঠেকিয়ে দেবে নিজের বুক পেতে। কিন্তু আজ যেদিকে চোখ যাবে, চারদিকে শুধু ধ্বংসলীলা। এই বনের শুরুর দিকের একটা সাহসী-সুন্দর গল্প: একটা মহিষের গলায় দড়ি দিয়ে নৌকা বেঁধে হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের মোক্তারিয়া ঘাট থেকে খাল পাড়ি দিয়ে একটি চরে গিয়ে উঠলেন ওসমান নামের এক সাহসী ব্যক্তি। মহিষের পেছন পেছন খাল সাঁতরে দ্বীপে উঠে এল ওসমানের গোটা মহিষের পাল। ওসমান সেই নির্জন চরে গড়ে তুললেন একটি বসতবাড়ি; সঙ্গে মহিষের বাথান। পরে নিয়ে গেলেন পরিবার। চল্লিশের দশকে সাগর মোহনায় মেঘনার বুকে জেগে ওঠা ওই চরের বুকে সেই প্রথম গড়ে উঠল মানববসতি; সেটা ১৯৬৫ সাল। চরটির নাম হয়ে গেল ‘চর ওসমান’। তাঁর দেখাদেখি চরে এসে বসতি গড়েন আরও অনেকে। কিন্তু ইতিহাস বলে, ১৯৭০-এর ভয়াবহ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যু ঘটে চরের সব মানুষের, হয়তো ওসমানেরও। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে চর ওসমানের নাম হয় নিঝুম দ্বীপ।
দ্বিমুখী নীতিতেই বিপর্যয় শুরু
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বঙ্গোপসাগর ও মেঘনার মোহনায় নিঝুম দ্বীপের চরটি জেগে ওঠে ১৯৪০-এর দশকে। সে সময় দ্বীপের আশপাশে প্রচুর চিংড়ি পাওয়া যেত বলে হাতিয়ার জেলেরা এর নাম দেন ইছামতীর চর। ১৯৫৯-৬০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ভূমিহীনদের স্থায়ী বসতি গড়তে চরের ৬২৫ একর জমি বন্দোবস্ত দেয়। তবে পাঁচ বছর পর্যন্ত সেখানে স্থায়ী বসতি হয়নি। এরপর ১৯৬৫ সালে রচিত হয় ওসমানের সেই গল্পের অধ্যায়।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, এই বনের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় সরকারের দ্বিমুখী নীতির ফলে; আর তা অব্যাহত থাকে ভোটের রাজনীতির চক্রে পড়ে। ১৯৭১ সালের পর সরকার একদিকে নিঝুম দ্বীপে বন তৈরির উদ্যোগ নেয়, অন্যদিকে ভূমিহীনদের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকার সেখানে ভূমিহীনদের জমি বন্দোবস্তের সিদ্ধান্ত নেয়। গঠন করা হয় ‘নিঝুম দ্বীপ ফাউন্ডেশন’। দ্বীপে নয়টি গুচ্ছগ্রাম ও একটি কলোনি গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি গুচ্ছগ্রামে ৫০টি পরিবারকে ঘর বানানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। খাওয়ার পানি ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের জন্য দ্বীপে ১৭টি পুকুর খনন করা হয়। এভাবে কলোনি ও গুচ্ছগ্রাম মিলে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মোট ৪৯১টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। বরাদ্দ দেওয়া জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৮২ একর।
একইভাবে ১৯৯৮-২০০০ সালে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ৫৬৩টি পরিবারকে ৬৭৫ দশমিক ৬০ একর জমি বরাদ্দ দেয় ভূমি কার্যালয়। এরপর শুরু হয় চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন (সিডিএসপি)-২ নম্বর প্রকল্পের কাজ। ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে একই প্রকল্পের আওতায় চার দফায় ৮৩৯টি পরিবারকে আরও ৯২২ দশমিক ৯০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়।
২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিঝুম দ্বীপকে নয়টি ওয়ার্ডে ভাগ করে ইউনিয়ন ঘোষণা করা হয়। এরপর সিডিএসপি প্রকল্পের আওতায় ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফায় ১ হাজার ৬৫৬টি পরিবারকে ২ হাজার ৪৮৪ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এভাবে বাড়তে বাড়তে বরাদ্দ দেওয়া মোট জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৬৪ দশমিক ৫০ একর।
ভোট-রাজনীতিতে বন উজাড়
গত বছরের মে ও অক্টোবর মাসে দুই দফায় নিঝুম দ্বীপে সরেজমিনে বন ধ্বংসের অসংখ্য আলামত চোখে পড়ে। দ্বীপের যে স্থানে হাশিম উদ্দিনের বাড়ি, আগে সেখানে কেওড়া বন ছিল। হাশিম বনের গাছ কেটে বাড়ি ও চাষের জন্য ৪০ শতক জমি বের করেন। সংরক্ষিত বনের গাছ কাটায় বন বিভাগের করা তিনটি মামলার আসামি তিনি। দীর্ঘদিন ধরে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন ৬৫ বছরের এই বৃদ্ধ। এখন তিনি নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে নিজের তৈরি বাড়িতে স্ত্রী ও এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন।
হাশিম উদ্দিন জানান, তাঁকে ভূমি কার্যালয় থেকে বসতভিটার জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু এ–সংক্রান্ত কোনো কাগজ তিনি দেখাতে রাজি হননি। তবে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বাড়ি করার জন্য তখনকার চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে বন উজাড়ে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
হাশিমের বাড়ি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ৩০-৪০ মিটার দূরে যে টিনের বাড়ি দেখা যায়, সেটি শাহাবুদ্দিনের (৬০)। তাঁর পৈতৃক ভিটা হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নে। ২০০৮ সালে নিঝুম দ্বীপকে ইউনিয়ন ঘোষণা করা হলে তিনিসহ প্রতিবেশী ভূমিহীন কয়েকটি পরিবার এখানে চলে আসে। পরে তিনি নিঝুম দ্বীপ ইউপির প্রথম চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ–সমর্থিত মেহরাজ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্বীপের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে বসত গড়েন।
শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন দ্বীপে আসি, তখন খালি জায়গা বলতে ছিল নদী ও সাগরের পাড়। এসব জায়গায় বসতবাড়ি গড়া যায় না। বনের জায়গা ছিল উঁচু। সেখানে বাড়ি বানাতে গেলে গাছ কাটতে হয়। মেহরাজ চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়েই গাছ কেটে বসতবাড়ি বানাই।’
গত ১০ মে শাহাবুদ্দিনের বাড়ির কাছে গিয়ে দেখা যায়, ৪০-৫০ মিটার দূরে দূরে মাটি তুলে দেড়-দুই ফুট উঁচু করে টিনের ঘর বানিয়েছেন বাসিন্দারা। চারদিকে আবাদি জমিতে ঘেরা এসব বাড়িতে ৩ থেকে ৮ সদস্যের পরিবারের বসবাস। এসব বাড়িঘর যে খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোও শ্বাসমূলীয় বনের গাছ।
দ্বীপের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বনের এখানে-সেখানে গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গাছের গুঁড়ি, ডালপালা। শিশু-কিশোরেরা ডাল ভেঙে রান্নার জন্য লাকড়ি সংগ্রহ করছে। এখন যে জমিগুলোতে চাষাবাদ হচ্ছে, সেগুলো যে আগে বনাঞ্চল ছিল, কাটা গাছের গুঁড়িগুলো উঁকি দিয়ে যেন তারই প্রমাণ দিচ্ছে।
স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা যায়, ২০০৩ সালে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে নিঝুম দ্বীপ ছিল নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড। সে সময় এই ওয়ার্ডের সদস্য নির্বাচিত হন জামায়াতের কর্মী তাজুল ইসলাম। তাঁর নেতৃত্বে দলে দলে ভূমিহীনেরা নিঝুম দ্বীপে বসতি গড়তে শুরু করেন। জানতে চাইলে তাজুল ইসলাম ‘নিঝুম দ্বীপে মানববসতি গড়তে নিজের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহারের পাশাপাশি গায়ে-গতরেও খেটেছেন’ বলে দাবি করেন। কিন্তু কোনো সমর্থন পাননি বলে আফসোসও আছে তাঁর। গত মে মাসে প্রথম আলোকে তাজুল বলেন, ‘এত ফাইট করে, দিনের পর দিন প্রশাসনে তাগাদা দিয়ে নিঝুম দ্বীপে ভূমিহীনদের জন্য বসত গড়ার চেষ্টা চালাইলাম। কিন্তু এখানকার মানুষেরা আমাকে ভুলে গেল।’ নিঝুম দ্বীপকে ইউনিয়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেও তিনি সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছেন বলে দাবি করেন।
বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক এবং আইইউসিএনের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশে যত বন দখল হয়েছে, সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক মদদ ছিল। নিঝুম দ্বীপ এর বড় উদাহরণ। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা দলীয় সমর্থক ও ভোটার বাড়াতে দ্বীপে জনবসতির সুযোগ তৈরি করেছে। আর সুযোগ পেয়ে সেই জনসাধারণ নির্বিচার উজাড় করেছে বনের গাছ।’ এভাবে ৫০ শতাংশের বেশি বন উজাড় হয়ে নিঝুম দ্বীপের পরিবেশ এখন নাজুক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বেশি বন উজাড় আ.লীগের ছত্রচ্ছায়ায়
২০০৮ সালে নিঝুম দ্বীপকে ইউনিয়ন ঘোষণা করার পর দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আওয়ামী লীগের হাতে। হাতিয়ার তৎকালীন সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর হাত ধরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মেহরাজ উদ্দিন। পরে নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মেহরাজ। অভিযোগ আছে, মোহাম্মদ আলীর ছত্রচ্ছায়ায় বন দখলের ধ্বংসযজ্ঞ চালান মেহরাজ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। বন উজাড়ে মেহরাজের সঙ্গী হয়ে কেউ কেউ স্বল্পমূল্যে জমি কিনেও বসতি গড়েন।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, চেয়ারম্যান হওয়ার আগে থেকেই জলদস্যুদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল মেহরাজের। সেই সূত্রে নিঝুম দ্বীপে তাঁর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি ও তাঁর নিকটাত্মীয়রা বনের গাছপালা কেটে জমি বের করা শুরু করেন। পরে এসব জমি ভূমিহীনদের কাছে বিক্রি করেন। তথ্য অধিকার আইনে করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বন বিভাগের দেওয়া তথ্যে বলা হয়, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বন বিভাগের পক্ষ থেকে মেহরাজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে নয়টি মামলা করা হয়।
মেহরাজ উদ্দিনের শ্বশুরপক্ষীয় আত্মীয় হলেন আবদুল মালেক (৬২), যাঁর বাড়ি নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা বাজারের পূর্ব দিকে। বাস্তুহারা লীগের বিভাগীয় আহ্বায়ক হিসেবে পরিচয় দেওয়া এই ব্যক্তি স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘মালেক নেতা’ নামে পরিচিত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বাস্তুহারা মানুষদের জন্য আমি এখানে বসতি স্থাপনের অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু বন বিভাগ বারবার বাধা দিয়েছে; আগে থেকে যারা বাস করত, তারাও বাধা দিয়েছে। পরে স্থানীয়দের সঙ্গে বহিরাগতদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।’
এজাহারে বন দখলের চিত্র
২০২২ সালের ২৩ এপ্রিল সকালে নিঝুম দ্বীপের বউবাজার এলাকায় ৮-১০ জনের একটি দলকে মাটি কাটতে দেখা যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বসতবাড়ির ভিটা তৈরি। কেউ কেউ গেওয়াগাছের চারা উপড়ে বন পরিষ্কার করছিলেন। বন বিভাগের কর্মীরা টইল দিতে দিতে সেখানে পৌঁছালে লোকজন পালিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে নয়টি কেওড়াগাছের মোথা, সাতটি কেওড়া লগ, ৯০০ গেওয়াগাছের চারা এবং একটি বড় দা, কোদাল, করাত জব্দ করেন বন বিভাগের কর্মচারীরা। পরে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করে বন বিভাগ। যে স্থানে বাড়িঘর তৈরির প্রক্রিয়া চলছিল, সেটি বন বিভাগের সংরক্ষিত এলাকা বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
বন দখলের এ ধরনের নানা চিত্র উঠে এসেছে বন বিভাগের করা বিভিন্ন মামলার এজাহারে। তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আবেদনের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০০১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বন আইনে মোট ১৬১টি মামলা করেছে বন বিভাগ। এসব মামলার আসামি ১ হাজার ১৪০ জন। কয়েকটি মামলার বিচারে কিছু আসামিকে সাজা বা অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত এবং কিছু আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। ৭০টি মামলা বিচারাধীন আছে।
২০১৮ সালের আরেকটি মামলার এজাহারে বলা হয়, ওই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি নিঝুম দ্বীপের ছোঁয়াখালী বন ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকের নতুন চরে ২০-২২ জনের একটি দলকে গাছ কাটতে দেখা যায়। নেতৃত্বে ছিলেন নিঝুম দ্বীপের তৎকালীন চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন। পরে ঘটনাস্থল থেকে ৪২৮টি কেওড়াগাছের মোথা, এক টুকরি রিং করা গাছের বাকল, একটি কুড়াল ও একটি দা জব্দ করা হয়।
বন ও ভূমির সমন্বয়হীনতা
ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালের পর থেকে কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা অনুসরণ করে নিঝুম দ্বীপের জমিগুলো বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বন বিভাগের সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা গেছে। বন বিভাগকে এক নামে বরাদ্দ দিয়েছে সরকার, আবার একই ভূমি অন্য নামে বন্দোবস্ত দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। বন্দোবস্ত চূড়ান্ত হয়েছে দুই ধাপের সরকারি সিদ্ধান্তে।
এ ক্ষেত্রে নিঝুম দ্বীপের খাসজমি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে বনাঞ্চলের বিষয়টিকে বিবেচনাতেই নেওয়া হয়নি। এমনকি সরকারি পরিপত্রও উপেক্ষা করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ১৯৯৮ সালের পরিপত্রে বলা হয়, ‘বনভূমি হিসেবে নোটিফিকেশনকৃত এলাকার কোনো খাসজমি অথবা সরকারের বর্ণনানীতি অনুযায়ী বনায়নের জন্য বন বিভাগের প্রয়োজন এমন কোনো খাসজমি ভূমি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মতামত ব্যতীত কোনো প্রকার ইজারা/বন্দোবস্ত প্রদান করা যাইবে না।’ কিন্তু নিঝুম দ্বীপে বন্দোবস্ত দেওয়া জমিগুলোর ক্ষেত্রে বন বিভাগের লাগানো গাছপালা এমনকি ওয়াটার বডিও হাতনকশা করে ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে।
নিঝুম দ্বীপের নামার বাজারের এক কোনায় নোয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের চর ওসমান বিট অফিস। অফিসের সামনে থেকে নদীর দিকে বেরিয়ে যাওয়া খালটির ডান দিক থেকে মুক্তারিয়া খাল পর্যন্ত যে বনাঞ্চল দেখা যায়, এই এলাকা ‘চর কমলা’ নামে বন বিভাগের কাছে বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু ভূমি অফিসের নথিপত্রে এই এলাকার বড় অংশই ‘চর মুহিত’ নামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই নামে ভূমিহীনদের বন্দোবস্তও দেওয়া হয়েছে। তাঁরা বনের গাছ কেটে জমি বের করতে গেলে বন বিভাগের সঙ্গে দফায় দফায় মুখোমুখি অবস্থান ও উত্তেজনা তৈরি হয়। একইভাবে আরও চারটি চরকে আলাদা নামে বন্দোবস্ত দিয়েছে ভূমি ও বন মন্ত্রণালয়।
এ রকম সমন্বয়হীনতা ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার কারণে নিঝুম দ্বীপে বৃক্ষনিধন যেন নিত্যদিনের ঘটনা। বন বিভাগের কর্মকর্তারা নিজেদের অসহায় দাবি করে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে জাহাজমারা রেঞ্জের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কাগজে-কলমে নিঝুম দ্বীপের বনাঞ্চলের পরিমাণ ৪০ হাজার ৩৯০ একর। কিন্তু এর সীমানা এখনো নির্ধারিত হয়নি বলে বন বিভাগের পক্ষ থেকে তেমন কিছুই করার নেই।
উদ্যান আছে, সীমানা নেই
২০০১ সালের ৮ এপ্রিল নিঝুম দ্বীপ ও জাহাজমারা এলাকার মোট ১১টি চরের ৪০ হাজার ৩৯০ একর জমি নিয়ে ‘নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে শুধু চর ওসমানের জরিপ করা হয়েছে। ফলে বন বিভাগ শুধু এটিকেই নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করতে পারে। বাকি ১১টি চরে এখনো জরিপ হয়নি, সীমানাও নির্ধারিত হয়নি। এসব জমি গেজেটমূলে বন বিভাগকে দিয়েছে সরকার।
এমন প্রেক্ষাপটে বনের সীমানা নির্ধারণ করে নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান রক্ষার তাগিদে ২০১৪ সালে হাতিয়ার রফিক উদ্দিন এনায়েত নামে একজন সাংবাদিক উচ্চ আদালতে রিট করেন। ২০১৫ সালের ১১ মে উচ্চ আদালত নিঝুম দ্বীপের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জামিলুর রেজা চৌধুরী (এখন প্রয়াত), আইনুন নিশাতসহ আট সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল গঠনের নির্দেশনা দেন। ২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর বিশেষজ্ঞ দল নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান পরিদর্শন করে। বিশেষজ্ঞ দলের মতামত আমলে নিয়ে ২০১৭ সালের ১৫ মে থেকে পরের বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেশ কিছু নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান এলাকার জরিপ, ভূমি বন্দোবস্ত বাতিল করে ইতিমধ্যে বসবাসকারীদের অন্যত্র পুনর্বাসন এবং নতুন বনভূমি বন্দোবস্ত প্রদান না করা।
কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কেন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি জানতে চাইলে বন বিভাগের জাহাজমারা রেঞ্জ কর্মকর্তা এস এম সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জরিপ করার জন্য বারবার ইউএনও বরাবর চিঠি দিয়েছি। আদালতের নির্দেশনা, টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তের কথাও চিঠিতে উল্লেখ করেছি। কিন্তু কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, আমার জানা নেই।’
হাতিয়ার ইউএনও মো. ইবনে আল জায়েদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বনের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতনদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। আশা করছি, শিগগির বনের জমি জরিপের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এত দিনেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি প্রশ্ন করলে ইউএনও বলেন, তিনি হাতিয়ায় নতুন যোগ দিয়েছেন। কেন হয়নি, আগের ইউএনওরা বলতে পারবেন।
২০২৩-এর ২৮ আগস্ট থেকে গত ৯ এপ্রিল পর্যন্ত হাতিয়ার ইউএনও ছিলেন সুরাইয়া আক্তার। এখন তিনি নোয়াখালীর সুবর্ণচরের দায়িত্বে। জানতে চাইলে সুরাইয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর আগে তো রাজনৈতিক সরকার ছিল, কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে নানা ধরনের চাপ আসত।’ তিনি বলেন, নিঝুম দ্বীপের জমি অনেক আগে থেকে বন্দোবস্ত দেওয়া। এমনও দেখা গেছে, সরকার থেকে এক পক্ষকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে, আবার সিডিএসপি প্রকল্পের মাধ্যমে একই জমি অন্যজনকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। আবার যাঁর নামে বন্দোবস্ত দেওয়া, তিনি নেই, জমি অন্য কেউ ভোগ করছেন। এ রকম নানা জটিলতায় আসলে জরিপের কাজ আর হয়নি।
বন কেটে জনবসতি চলছেই
২০১৪ সালে বন বিভাগের সহব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের পর নিঝুম দ্বীপের বন উজাড় বন্ধ হয়েছে বলে বিভাগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। কিন্তু অতি সম্প্রতি নোয়াখালীতে সরেজমিনে দেখা গেছে, বনের গাছ উজাড় করে বাড়িঘর তৈরি ও ফসলের চাষ চলছেই। কৌশল হিসেবে প্রথমে বন ঘেঁষে বানানো হয় বাড়িঘর; তারপর বন উজাড় করে বের করা হয় চাষাবাদের জমি। আবার অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ওই সব বাড়িঘরে যাতায়াতের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে কাঁচা রাস্তা। এতে বন ঘেঁষে বসতি গড়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. সেলিম পরিবারের সঙ্গে থাকতেন নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা এলাকায়। পরে বসতি গড়েছেন ২ নম্বর ওয়ার্ডের মুরখালিতে। বনের জমিতেই করেছেন বসতঘর। খনন করেছেন পুকুর। আর বনের কোল ঘেঁষে চাষ করেছেন আমন ধান (লেম্বু ধান)। একইভাবে আরও অনেকে বনের জায়গা দখল করে বসতি গড়েছেন।
নিঝুম দ্বীপের বাসিন্দা সফি আহমেদ পেশায় রাজমিস্ত্রি। তিনি বলেন, বনের কোল ঘেঁষে যেসব পরিবার বসবাস করছে, তাদের বেশির ভাগেরই সরকারি বন্দোবস্ত নেই। তাঁদের আশা, একসময় বন্দোবস্ত পাওয়া যাবে। অনেকে আবার বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য ভূমি অফিসে আবেদনও করে রেখেছেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী]