একটি মেয়ের গল্প ও সাইবার অপরাধ

নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার হন বেশি
প্রতীকী ছবি

মেয়েটিকে বিষণ্ন দেখাচ্ছিল, ভীষণ উদ্বিগ্নও। এক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে চেম্বারে এসেছেন আইনি প্রতিকার নিতে। আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে আইনি লড়াইয়ে নামতে চান। আইনজীবীর সহায়তা নিয়ে আদালতে চাইবেন বিচার। মেয়েটির সঙ্গে কথা হলো অনেকটা সময় নিয়ে।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন এসেছেন?’ উত্তর দিলেন, ‘ছেলেটি আমার জীবন তছনছ করে দিচ্ছে। অথচ ভাবতেই অবাক লাগে, সে–ই আমার স্বামী ছিল। তার চেয়ে ভয়ংকর লাগে, আশ্চর্য লাগে, সেই ব্যক্তি আমার সন্তানের বাবা!’ তারপর একে একে বলতে থাকলেন...

ছেলেটির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবেই। তাঁদের চার বছরের সংসারের শুরুতে সম্পর্ক ভালোই ছিল। বিয়ের শুরুতে সম্পর্ক ভালো থাকার সময় তাঁদের নিজেদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো নিজেরাই মুঠোফোনে ক্যামেরাবন্দী করে রাখতেন অনেক সময়। কখনো কখনো স্বামী তাঁর অজান্তেই মুঠোফোনে ধারণ করতেন। তাঁদের অগণিত ব্যক্তিগত কথোপকথনও রয়েছে মেসেঞ্জার আর হোয়াটসঅ্যাপে। মেয়েটি ভেবেছিলেন, এই তো সুখের সংসার! স্বপ্নের চেয়েও যেন সুন্দর! কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই স্বামীর চেহারা পাল্টাতে থাকে। নিমেষেই ওলট–পালট হয়ে যায় যেন সবকিছু, সব স্বপ্ন। মেয়েটি জানতে পারেন, ছেলেটি অন্য কোথাও সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন। হঠাৎ ছেলেটির মুঠোফোন ঘাঁটতে গিয়ে দেখতে পান, অন্য মেয়েদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সব কথোপকথন, অশ্লীল ছবিবিনিময়।

অবশ্য বেশ কয়েক মাস ধরেই স্বামীকে যেন অন্য মানুষ মনে হচ্ছিল তাঁর। ঠিক শুরুর দিকের মতো মেলাতে পারতেন না। কিন্তু এর পেছনে যে এতটা বীভৎসতা লুকিয়ে ছিল, কে জানত! ছেলেটিকে বুঝিয়ে–শুনিয়ে বারবার ফেরাতে চাইতেন। কিন্তু কাজ হয়নি। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য লেগেই থাকত। কখনো কখনো ছেলেটি তাঁকে মারধরও করতেন। এমনকি মোটা অঙ্কের যৌতুকের জন্য চাপ দিতেন। এর মধ্যে তাঁদের একটি সন্তানও আসে সংসারে। কিন্তু এতেও স্বামীকে ফেরানো যায়নি। পরবর্তী সময়ে মেয়েটি আর সহ্য করতে না পেরে স্বামীকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং পরিবারের সিদ্ধান্তেই স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসেন। তালাকের নোটিশ পাঠান স্বামীকে।

কিন্তু এরপরই শুরু হয় মেয়েটির জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। সেই স্বামী তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তিগত কথোপকথন ও ছবি বিভিন্নজনকে পাঠাতে থাকেন এবং ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। মেয়েটি তাঁকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও থামানো যায়নি। এখনো থামছেন না। এর মধ্যে মেয়েটি কোনোভাবে জানতে পারেন, কোনো একটি অনলাইন মাধ্যমে তাঁর অশ্লীল ছবি ছাড়া হয়েছে, যা কিনা তাঁর স্বামীই ধারণ করেছিলেন মুঠোফোনে।

নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার হন বেশি
প্রতীকী ছবি

মেয়েটির বন্ধুবান্ধব, ফেসবুকে পরিচিত অনেকের কাছেই ছেলেটি আজেবাজে কথাবার্তা লিখে পাঠাচ্ছেন। মেয়েটির ব্যক্তিগত ছবি দিয়ে এবং কিছু ছবি এডিট করে অন্য ছেলেদের ছবি জুড়ে দিয়ে ছড়াচ্ছেন কুৎসা। মেয়েটি এখন মামলা করতে চান। শুরুতে নিকটবর্তী থানায় গেলে তারা জিডি নেয়। কিন্তু এতেও ভয় পাননি ছেলেটি।

তাঁর সংসার ও সন্তানের জীবন বিপন্ন হয়েছে। আর অপমান ও মানহানির শিকার হতে চান না তিনি। এ সাইবার অপরাধীর হাত থেকে পরিত্রাণ চান তিনি। চান ছেলেটির কঠিন শাস্তি। মেয়েটিকে বলি থানায় আবার যেতে। মেয়েটি জানান, থানায় মামলা নেবে না। তাঁকে বলি, তাহলে নালিশি মামলা করতে হবে সাইবার ট্রাইব্যুনালে। সঙ্গে হলফনামা দিয়ে বলতে হবে যে থানায় মামলা গ্রহণ করেনি। মেয়েটি মামলা করার সিদ্ধান্তে অটল।

এ তো গেল মেয়েটির গল্প। এ রকম কিংবা এর চেয়েও ভয়াবহ সাইবার অপরাধের ঘটনা ঘটছে সমাজে। এর হয়তো সিকি ভাগ আদালত পর্যন্ত আসে।

সাইবার অপরাধের ধরন

প্রযুক্তির যত উন্নতি হচ্ছে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধের ধরনও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটছে ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে হয়রানি বা হেয় করা।

বেশি দেখা যায় প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে কেউ একজন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আগে ধারণ করা নিজেদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়। কোনো কোনো সময় ব্ল্যাকমেলের জন্য গোপনে ছবি তোলে কিংবা ভিডিও ধারণ করে এবং পরবর্তী সময়ে হুমকি দেয়। এমনও হয়, মুঠোফোনে বা ল্যাপটপে ধারণ করা ছবি বা ব্যক্তিগত তথ্য কেউ হ্যাক করে ছড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া চুরি হয়ে যাওয়া ল্যাপটপ বা মুঠোফোন থেকেও তথ্য হাতানোর ফলে অপরাধের শিকার হতে হয়।

ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম অন্যের দখলে নেওয়া থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে নিজের ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ অনলাইন অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমগুলো সাইবার অপরাধীরা দখলে নেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন আকর্ষণীয় অফারের লিংক পাঠিয়ে এতে ক্লিক করতে বলে এবং এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দখলে নেয়, যাকে সাধারণত ‘ফিশিং’ বলা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ‘ম্যালওয়ার’-এর মাধ্যমেও সাইবার অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। এ ছাড়া ক্র্যাক সফটওয়্যার, পিডিএফ ফাইল বা ওর্য়াড ফাইল কিংবা ই–মেইলের মাধ্যমেও হ্যাক হতে পারে যেকোনো ডিভাইস। সাইবার বুলিং এবং যৌন হয়রানির ঘটনা তো হামেশাই হচ্ছে। অনলাইন কেনাকাটাসহ অন্যান্য লেনদেনেও হচ্ছে প্রতারণা এবং জালিয়াতির মতো ঘটনা। অনলাইন মাধ্যমে আইনবহির্ভূত ই-ট্রানজেকশন এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও গুরুতর সাইবার অপরাধ।

সচেতনতা

সাইবার অপরাধের শিকার থেকে বাঁচতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা। নিজেদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত কৌতূহলবশত কিংবা নিজেদের ইচ্ছায়ও ক্যামেরাবন্দী করা উচিত নয়। হয়তো সম্পর্কের অবনতি হলে এ বিশেষ মুহূর্তই নিজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ই–মেইলে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা উচিত। দ্বিস্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা, যেটাকে ‘টু ফ্যাক্টর অথেনটিফিকেশন’ বলা হয়, তা নিশ্চিত করা। কোনোভাবেই রাগ, অভিমান বা অবেগের বশে কাউকে নিয়ে বিরূপ কোনো কিছু লেখা বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াও উচিত নয়, যাতে মানহানির অপরাধে অভিযুক্ত হতে হয়। কোনো আকর্ষণীয় লিংক বা ফাইলে হুট করেই প্রবেশ করা উচিত নয়। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যতটা সম্ভব নিজের ব্যক্তিগত তথ্য ও অবস্থান কম দেওয়া যায়, ততই ভালো।

নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার হন বেশি
প্রতীকী ছবি

প্রতিকার

যদি কেউ যেকোনো ধরনের সাইবার অপরাধের শিকার হন, তাহলে প্রথমেই প্রমাণ ও আলামত সংগ্রহের দিকে মনোযোগী হতে হবে। ফেসবুকসহ যেকোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনলাইনে যেখানেই হোক না কেন, প্রথমে স্ক্রিনশট ও ওয়েব লিংক এবং ঠিকানা সংগ্রহ করে রাখতে হবে। দ্রুত নিকটবর্তী থানায় এটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে হবে। যদি কেউ সরাসরি মামলা করতে চান, তাহলে থানায় এজাহার করতে হবে। যদি কেউ শুধু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে চান, মামলা করতে না চান, তাহলে পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন কিংবা সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের কাছে জিডির কপিসহ লিখিত অভিযোগ করা যায়। তারা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। অপরাধ তদন্ত সাপেক্ষে মামলাও করতে পারে।

কোনো ভুক্তভোগী মামলা করতে চাইলে থানায় মামলা না নিলে সাইবার ট্রাইব্যুনালে সরাসরি মামলা করা যায়। তবে ট্রাইব্যুনালে মামলা করলে ট্রাইব্যুনাল সরাসরি মামলা আমলে নেবেন না। অভিযোগটি তদন্তে পুলিশ বা যেকোনো সংস্থাকে নির্দেশ দিতে পারেন অথবা থানায় মামলাটি এজাহার হিসেবে গণ্য করার আদেশ দিতে পারেন।

বর্তমানে বিভাগ অনুযায়ী কয়েকটি সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। বহুল আলোচিত-সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ বলবৎ আছে দেশে। যদিও বেশির ভাগ সাইবার অপরাধের বিচার হয় এ আইনের আওতায় কিন্তু সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারপদ্ধতির কথা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ২০০৬(সংশোধনী ২০১৩)-এ উল্লেখ আছে। সাইবার আইন ছাড়াও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ অনুযায়ী পর্নোগ্রাফি–সংক্রান্ত অপরাধের বিচার হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। এ ছাড়া জামিনযোগ্য এবং জামিনের অযোগ্য অপরাধ আলাদা করা হয়েছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের আদেশ এবং রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয় হাইকোর্ট বিভাগে।

তানজিম আল ইসলাম আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট