সহানুভূতি প্রকাশ কোথায় হারিয়ে গেল, প্রশ্ন অনেকের

উদ্যোক্তাদের একটি গ্রুপে একজন আজ সন্ধ্যার মধ্যে ‘কেটে, বেছে ধুয়ে হাঁসের মাংস’ কে সরবরাহ দিতে পারবেন, তা জানতে চেয়েছেন।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার আঠুলিয়া ইউনিয়নের বিড়ালক্ষ্মী গ্রামে গাছ উপড়ে পড়েছে ঘরের ওপর। সোমবার বেলা তিনটায়ছবি: প্রথম আলো

প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে দেশের উপকূলীয় ছয় জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতির মুখে পড়েছে উপকূল ও আশপাশের ১৯ জেলা। জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে অনেক এলাকা। ৩৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী যখন দুর্ভোগ ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন একশ্রেণির মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বৃষ্টিবিলাস করছেন। কেউ কেউ খিচুড়ির ছবি, বৃষ্টিতে ভেজার সুখকর ছবি শেয়ার দিচ্ছেন। উদ্যোক্তাদের জামাকাপড় বিক্রির ঘোষণাতেও বিরতি নেই।

উদ্যোক্তাদের একটি গ্রুপে একজন আজ সন্ধ্যার মধ্যে ‘কেটে, বেছে ধুয়ে হাঁসের মাংস’ কেউ সরবরাহ দিতে পারবেন কি না, তা জানতে চেয়েছেন। উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীরা ফেসবুকে খিচুড়ির ছবি দিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।
তবে ফেসবুকে এই বৃষ্টিবিলাসের কেউ কেউ বিরোধিতাও করছেন। সংবেদনশীল মানুষ, বিশেষ করে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো ফেসবুকে মানুষের আনন্দ দেখে কষ্ট পাচ্ছে। মানুষের কষ্টে সহানুভূতি প্রকাশ কোথায় হারিয়ে গেল, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল গতকাল রোববার রাত আটটার দিকে মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের পটুয়াখালীর খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ উপকূলের বিভিন্ন জেলায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে বেশির ভাগ জেলার দমকা বাতাস ও ভারী বৃষ্টি হচ্ছে।

ফটোগ্রাফার জয়িতা তৃষা (ফেসবুকে জয়িতা আফরিন) ফেসবুকে লিখেছেন, এটা খিচুড়িবিলাস করার বৃষ্টি না। কোনটা সাইক্লোন/দুর্যোগ আর কোনটা মনসুন রেইন, এটা বোঝার জ্ঞান অন্তত আল্লাহ আমাদের দিক। নদী ও উপকূল অঞ্চলের মানুষের পাশাপাশি পশুপাখি যাতে ভালো থাকে, সৃষ্টিকর্তার কাছে সে প্রার্থনাও করেছেন তিনি।

জয়িতা তৃষা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফেসবুকে অনেকের পোস্ট দেখতে বাজে লাগছিল। ঢাকাতেই আজ এই অবস্থা, সেখানে উপকূলের কী অবস্থা তা কে জানে। সবজি-ফসল নষ্ট হচ্ছে। সবকিছুর দাম বাড়বে। ঢাকায় বা অন্য জায়গায় বসে যাঁরা ফেসবুকে বৃষ্টি বা খিচুড়িবিলাস করছেন, তাঁরাও দুদিন পর এই যে ক্ষতি হচ্ছে তার প্রভাব বুঝতে পারবেন।’ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা কেন থাকবে না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুললেন এই ফটোগ্রাফার।

সাংবাদিক জেসমিন পাপড়ি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘উপকূলে প্রতিটা দুর্যোগ একবুক উৎকণ্ঠা নিয়ে আসে। নেটওয়ার্কহীন সময় পার করে আব্বু-আম্মু। আর বুকে পাথর সমান চাপ নিয়ে ঢাকায় বসে সময় গুনি আমরা ভাই-বোনেরা। যারা উপকূলের কুঁড়েঘরে বসে এসব ঝড় দেখেনি কখনো, চোখের পলকে বাঁধ ভেঙে সব ভেসে যাওয়া সহ্য করতে হয়নি যাদের, তারা অবশ্য এ অনুভূতি বুঝবে না।’

ঝড় শেষে বাবা ফোন করে জানাবেন তাঁরা সবাই ভালো আছেন, এ অপেক্ষায় আছেন জেসমিন পাপড়ি। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কৈখালী ইউনিয়নে। আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে তিনি জানালেন, বাড়িতে বাবা, মা, ভাইয়ের স্ত্রী, ভাগনে থাকে। বাবা-মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এলাকার দু-একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তাতে বাড়ির কাছের বাঁধটি এখনো ভাঙেনি, বাঁধের কানায় কানায় পানি। তবে আক্ষেপ করে বললেন, বাঁধের অবস্থা ভালো না।

খুলনার দাকোপের পশ্চিম ঢাংমারীতে পিয়ালি ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা আঁখি সিদ্দিকা। তিনি খুলনার মেয়ে। ঢাকায় চাকরি করেন। তবে বর্তমানে আছেন এ রিসোর্টে। তিনি যখনই নেটওয়ার্ক পাচ্ছেন, তখনই ফেসবুকে রিসোর্ট এবং আশপাশের ভয়াবহতার ভিডিও ও ছবি পোস্ট করছেন ফেসবুকে। কথা কেটে যাচ্ছিল বলে মেসেঞ্জারে লিখে তিনি জানালেন, রিসোর্ট ছাড়াও স্থানীয়দের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকেছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত পটুয়াখালী জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকা। সোমবার দুপুরে শহরের কালিকাপুর এলাকায়
ছবি: শংকর দাস

আঁখি সিদ্দিকা জানালেন, ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে শনিবার দুপুরে রিসোর্ট দুটোর অতিথিদের একরকম জোর করেই রিসোর্ট ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তাঁরা ঝড় দেখবেন বলে রিসোর্ট ছাড়তে চাইছিলেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘মানুষের শখ দেখে অবাক হই।’

রিমাল দুর্বল হয়ে পড়েছে, পায়রা, মোংলা, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজার থেকে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত উঠিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। উপকূল অঞ্চলে থাকা মানুষ বলছেন, দুর্বল হওয়ার পরও রিমালের যে তাণ্ডব, আর এটি যদি সক্রিয় থাকত, তাহলে কী অবস্থা হতো, তা কেউ চিন্তাই করতে পারছেন না।

ঢাকার উদ্যোক্তা নাহিদ সুলতানা। বর্তমানে তিনি অন্যান্য উদ্যোগের পাশাপাশি দক্ষিণ অঞ্চলের মাছ নিয়ে ব্যবসা করছেন। তাঁর স্বামী ব্যবসার কাজে বাগেরহাটে নিজের বাড়িতে আছেন। সেখান থেকে স্বামীর তোলা ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করে নাহিদ সুলতানা ফেসবুকে লিখেছেন, বৃষ্টিতে খিচুড়ি খাওয়ার অভিজ্ঞতার পোস্ট দিচ্ছেন, তাঁদের উপকূলীয় অঞ্চলে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? ঘরের টিন উড়ে যাওয়ার আশঙ্কা, ১০–১৫ ফুট উচ্চতার ঢেউয়ে ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ার আতঙ্কের মধ্যে আয়েশ করে খিচুড়ি খেতে পারতেন?

ঢাকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ পেশাগত কাজে বর্তমানে সুন্দরবনের সাতক্ষীরার গাবুরা এলাকায় আছেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, যারা বিল্ডিং এ বইসা খিচুড়ি খাইতে চায় তাদের উপকূলীয় অঞ্চলের টানা ১৯ ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া উচিত।

রিমালের প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়ায় গাছ উপড়ে পড়ে পল্লী বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। হোয়ানক এলাকা, মহেশখালী, কক্সবাজার, ২৭ মে
ছবি: প্রথম আলো

ইউনিসেফ বাংলাদেশ ফেসবুক পেজে জানিয়েছে, রিমালে ৮৪ লাখ মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে ৩২ লাখই শিশু। এই শিশুদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশন, নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

ফেসবুকে খিচুড়িবিলাস করলে বা না করলেও রিমালের গতিপথ পাল্টাবে না বলেও উল্লেখ করেছেন অনেকে। তবে  সুবীর চক্রবর্তী নামের একজন লিখেছেন, ‘আপনি নিরাপদে আছেন বলে রোমান্টিক গান শুনে খিচুড়ি খেয়ে ওয়েদার উদ্‌যাপন করেন কোনো সমস্যা নেই, তবে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে হাসিঠাট্টা করাটা অশোভন।’