মনের ক্ষত সারায় বিশুদ্ধ সংগীত

রাজধানীর গুলশানের ইএমকে সেন্টারে মঙ্গলবার রাতে শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী সামিয়া মাহবুব আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতি মানুষের মনের ব্যথার শুশ্রূষা করে। আর যান্ত্রিক এই জটিল জীবনযাপনের মধ্যে সেই প্রকৃতির কাছে যাওয়া খুব সহজও নয়। অন্যতম উপায় হচ্ছে শাস্ত্রীয় সংগীতের সুরের কাছে সমর্পণ। প্রথম আলোর কাছে নিজের অনুভবের কথা এভাবে বললেন শিল্পী সামিয়া মাহবুব আহমেদ।

শিল্পী যে বহু নিবেদনের মধ্য দিয়ে সেই সমর্পণে আত্মস্থ হয়েছেন বোঝা গেল তাঁর পরিবেশনার সময় শ্রোতাদের মৌনতায়। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর গুলশানের ইএমকে সেন্টারে ছিল শিল্পী সামিয়া মাহবুব আহমেদের ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশনা। এক মাসের জন্য দেশে এসেছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগের দিন আজ বুধবার প্রথম আলোর সঙ্গে সুর, সংগীত ও মানসিক প্রশান্তি নিয়ে নিজের উপলব্ধির কথা বললেন কিরানা ঘরানার শিল্পী সামিয়া মাহবুব। বললেন, পৃথিবীর যেকোনো গানের মূলে থাকে শাস্ত্রীয় সংগীতের ছায়া। আর উচ্চাঙ্গসংগীতের সাধনা করতে হয় সারা জীবন। শিল্পী বললেন, শাস্ত্রীয় সংগীতের মূল ধারার ধ্রুপদ, খেয়াল, ধামাল, ঠুমরি বিশুদ্ধ ধ্রুপদি হিসেবে শেখেন এ ধারার শিল্পীরা। সেটা ভালোভাবে শেখা গেলে যেকোনো গানই সমৃদ্ধ হয়।

সংগীতের ভিন্ন ভিন্ন রাগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সামিয়া মাহবুব প্রথম আলোকে বললেন, ‘এ এক যাত্রা পথের মতো। রাগ ইমন নিয়ে বসলে মনে হয় চারপাশে তখন ইমনেরই প্রতিধ্বনি। রাগ বেহাগ নিয়ে বসলে মনে হয় সে রাগটিই বেজে চলেছে সবখানে। শাস্ত্রীয় সংগীতের গভীরতা ও সৌন্দর্যের জন্যই এ ধারাকে শিল্পীরা ভালোবাসেন।’

শিল্পী সামিয়া মাহবুব আহমেদ শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি নজরুলসংগীত, ভজন ও লোকগীতি গান
ছবি: সংগৃহীত

শিল্পী সামিয়া মাহবুব আহমেদ দেশের বাইরে আছেন আশির দশকের শেষ সময় থেকে। সংগীতে তাঁর তালিম নেওয়া শুরু হয় বাংলাদেশে, ১৯৮৪ সালে তপনকান্তি বৈদ্যের কাছে। ১৫ বছর তাঁর কাছেই তালিম নিয়েছেন। শিল্পী সামিয়া মাহবুবের স্বামী বিশ্বব্যাংক গ্রুপের মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সির (এমআইজিএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট জুনায়েদ কামাল আহমেদ ২০০০ সালে কাজের সূত্রে ছিলেন ভারতের দিল্লিতে। শিল্পীকে চলে যেতে হয় তখন সেখানে। ভারতে তিনি তালিম নিতে শুরু করেন পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত বিদূষী সুমিত্রা গুহর কাছে। এখনো তাঁর শিষ্য এ শিল্পী। ২০০৫ সাল থেকে গুরুদের অনুমতি নিয়ে সামিয়া মাহবুব শুরু করেন নিজের শিক্ষকজীবনের পর্ব। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে তাঁর শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষার্থী। সংগীতই তাঁর চারপাশের প্রকৃতি।  

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে কিরানা ঘরানার দিকপাল ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ। একই ধারার শিল্পী সামিয়া জানালেন, তাঁর দুই সন্তানও শাস্ত্রীয় সংগীতের শিল্পী। মেয়ে ইরাম আহমেদ ভালো বেহালা বাজান। ছেলে আবরার আহমেদ বাজান ক্লারিওনেট বাদ্যযন্ত্র। দুই ভাই–বোনই মায়ের সঙ্গে সংগত করেন।

শাস্ত্রীয় সংগীতের ‘খেয়াল’ হচ্ছে এ শিল্পীর গায়কির অন্যতম প্রাধান্য। শাস্ত্রীয় সংগীতের বাইরে গাইলে সাধারণত নজরুলসংগীত, ভজন ও লোকসংগীত পরিবেশন করেন তিনি। প্রথম আলোকে শিল্পী সামিয়া মাহবুব বললেন, ‘সব ধারাতেই রাগ লুকিয়ে আছে। কোনো কোনো সময় একই গানে একাধিক রাগের ছায়া থাকে। নিজে শাস্ত্রীয় সংগীতের ছাত্রী। তাই গান শুনলেই রাগের ভিত্তিতে সেটাকে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করি।’

তাঁর গান মানুষের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সামিয়া মাহবুব প্রথম আলোকে বললেন, ‘বৈজ্ঞানিকভাবেই ব্যাখ্যা করুন আর আবেগের দিক থেকে, বিশুদ্ধ সুন্দর সুর সব সময় মানুষকে ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যায়। যেখানে সুর হয়ে যায় ধ্যানের অন্যতম বিশেষ স্তর। নাদ ইয়োগা, নাদ ধ্যান—এসবই শব্দ দিয়ে মনের অনেক অশান্ত অবস্থাকে স্থির অবস্থায় নিয়ে আসে।’

ছেলে আবরার আহমেদ ও শিল্পী সামিয়া মাহবুব আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

শিল্পীর কথায় উঠে আসে প্রকৃতির সঙ্গে সুরের সম্পর্কের কথা। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের চারপাশে প্রকৃতির অফুরন্ত এক ভান্ডার আছে। সেখানে কত ধরনের শব্দ তৈরি হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। সংগীতের মূল শব্দ সা রে গা মা পা ধা নি সা স্বরগুলো এসেছে প্রকৃতি থেকেই। ফলে আমরা যখন শাস্ত্রীয় সংগীত গাই এবং শুনি তখনই আমরা সরাসরি প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছি। এতে মন যেমন শান্তি খুঁজে পায়, তেমনি শান্ত হয়ে আসে। তাই শাস্ত্রীয় সংগীত মানুষের মনকে প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত করে ও মন বিশুদ্ধ করে দেয়।’

মনে করা হয়, শাস্ত্রীয় সংগীত পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। পরম্পরায় চলে আসছে এর ধারাবাহিকতা। সেই ধারাবাহিকতারই একজন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের কিরানা ঘরানার শিল্পী সামিয়া মাহবুব আহমেদ, যাঁর কণ্ঠের স্থির সুর দূর করে দেয় শ্রোতার মানসিক যন্ত্রণা।