অনুপ্রেরণার এক দীর্ঘ যাত্রা

অধ্যাপক শাহলা খাতুনছবি: প্রথম আলো

জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুনের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৯ জুন। তার মানে, তিনি ৮৬ বছর পার করে ৮৭ বছরের দিকে এগিয়ে চলেছেন। হাসিমুখ, আত্মবিশ্বাসী, স্বাবলম্বী, সচেতন তাঁর এই এগিয়ে চলা। আমাদের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ গুরুজনদের কাছে আমরা যাই ‘ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো’ নামের ভিডিও সাক্ষাৎকারমালার অংশ হিসেবে। ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫-এ আমরা গিয়েছিলাম ডা. শাহলা খাতুনের কাছে, তাঁর বনানীর বাসভবনে। তাঁর মুখ থেকে আমরা শুনেছি জীবন-অভিজ্ঞতার নানা কথা।

তাঁর আব্বা আবু আহমদ আব্দুল আজিজ ছিলেন আইনজীবী, খেলাফত আন্দোলন থেকে পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, সিলেট ল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই।

১৩ ভাইবোনের বিশাল পরিবার ছিল তাঁদের। তিনি বলেন, ‘যত রকমের দুনিয়াতে খেলা আছে, আমাদের বাড়িতে হতো। ওই তখনকার দিনে আমার মা ব্যাডমিন্টন-ট্যাডমিন্টন খেলতেন। আর আমরা তো কত যে খেলা খেলেছি!’

সিলেট সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৫৪ সালে। সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ১৯৫৬ সালে। ছোটবেলা থেকেই চেয়েছেন ডাক্তার হতে। তাই ঢাকায় এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন। ১৯৬১ সালে পাস করে বের হন। সেই সময়ে পাস করা খুবই কঠিন ছিল। ১৯৫৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের একটা ক্লাব আছে। নাম ‘১৯৫৬ ক্লাব’। তাঁদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন, সক্রিয় আছেন, দেশে–বিদেশে একত্র হন আর প্রচুর সামাজিক সেবামূলক কাজ করে থাকেন।

এমবিবিএস পাস করে হেলথ সার্ভিসে (আপার) যোগ দেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে পোস্টিং হয়। ১৯৬৪ সালে তাঁর সহপাঠী শেখ হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বৃত্তি পেয়ে দুজনে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে যান। ডা. কবীর এফআরসিএস ডিগ্রি লাভ করেন। শাহলা খাতুন এমআরসিওজি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেখানেই তাঁদের মেয়ে লুবনা কবীরের জন্ম। ১৯৬৮ সালে দুজনেই দেশে ফিরে আসেন। খুলনা সদর হাসপাতালে দুজনের পোস্টিং হয়। ছেলে সায়ীদ কবীরের জন্ম হয়। ছেলের বয়স যখন ৭ মাস, তখন শেখ হুমায়ুন কবীর খুলনা থেকে যশোর বিমানবন্দরে আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় দুনিয়া থেকে চলে যান।

শাহলা খাতুন ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঢাকা চলে আসেন। আইপিজিএমআরে ভর্তি হন। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সিলেটে চলে যান। সেখানে তাঁদের বাড়ি আক্রান্ত হয়। শুরু হয় দেশের মধ্যে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছোটাছুটি। ১৯৭৪ সালে ডা. শাহলা যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে ইসিজিএমজি পরীক্ষায় পাস করেন। কিছুদিন ডাক্তারি করেনও সেখানে। তবে চলে আসেন দেশে। পিজি হাসপাতালে যোগ দেন।

১৯৭৫ সালে কর্নেল ডা. এ এম খানের সঙ্গে বিয়ে হয়। ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে বনানীর বাসার সামনে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন এ এম খান। সেখানেই হার্ট অ্যাটাক। সেখানেই মারা যান তিনি।

ডা. শাহলা শিক্ষকতাকেই জীবনের ব্রত করে তোলেন। এমবিবিএস থেকে শুরু করে এফসিপিএস, এমএস, পিএইচডি— তিনি পড়িয়েছেন, ক্লাস নিয়েছেন, কোর্স সাজিয়েছেন, পরীক্ষা নিয়েছেন, ট্রেনিং দিয়েছেন। আবার গাইনির ডাক্তার হিসেবে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন অসংখ্য মানুষকে।

তরুণ চিকিৎসকদের তিনি দুটো পরামর্শ দিয়েছেন। এক. পরিচিত রোগী পেলে প্রথমেই গল্প করবে না। আগে চিকিৎসক হিসেবে প্রয়োজনীয় কথা বলা, কথা শোনা, চিকিৎসা দেওয়া, ব্যবস্থাপত্র দেওয়া। চিকিৎসার কাজ শেষ হয়ে গেলে গল্পগুজব। তা না হলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার কথাটা ভুলে যেতে পারো।

আর দ্বিতীয় পরামর্শ, তাঁর নিজের কথায়, ‘আমার জুনিয়রদের বলব—ধৈর্য ধরা শিখতে। তাড়াহুড়ো না করতে। প্রত্যেক কিছুতে হোমওয়ার্ক করে আসতে। এরা হোমওয়ার্ক করার সময় পায় না, এটা আরেকটা অসুবিধা। আমি যেটা করি, হোমওয়ার্ক করি। আমি যদি ছয়টায় কোনো কেস করতে যাই, আমি পাঁচটার সময় বসে সেটা একবার দেখি। এটা বলি যে, “বই পড়ো, বই পড়ো, ডাক্তারি ম্যাগাজিন পড়ো। অনেক খবর পাবে। ইভেন গুগল দেখো।”’

আরও বললেন তিনি, ‘প্রথমে নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেবে। এরপর পরিবার। পরিবারই আসল।’

ডা. শাহলা খাতুনের কর্মময় দীর্ঘ জীবনের টুকরো টুকরো গল্প শুনতে পারাটা সত্যিকার অর্থেই একটা সৌভাগ্যের বিষয়। তাঁর ইতিবাচক প্রাণশক্তি শ্রোতার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। তৈরি হয় একটা ইতিবাচকতার আবহ।

  • আনিসুল হক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক