কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় হলেও রপ্তানিতে কেন পিছিয়ে বাংলাদেশ

ভূপ্রকৃতি অনুকূলে থাকায় বাংলাদেশে প্রচুর কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। কাঁঠাল উৎপাদনে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। তবে উৎপাদনে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে থাকার পরও কাঁঠাল ও কাঁঠালজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার না বাড়ায় এর রপ্তানি বাড়ছে না। কাঁঠাল থেকে চিপস, আচার, জেলিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে মূল্য সংযোজনও নিশ্চিত হবে। মূল্য সংযোজন মানে হলো, একটি পণ্যের নানামুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সেটির বাজারমূল্য বাড়ানো।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে কাঁঠাল উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে ভারত। দেশটিতে প্রতিবছর কাঁঠালের উৎপাদন হয় ২০ লাখ মেট্রিক টন। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার ১৩১ মেট্রিক টন কাঁঠাল, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬ হাজার ১৩১ টন বেশি।

কাঁঠাল মৌসুমি ফল। একই মৌসুমে আম, আনারস, লিচু হয়। এসব ফলের ভিড়ে কাঁঠালের প্রতি একধরনের অনীহা দেখা যায় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের ভাষ্য, কাঁঠালের সংরক্ষণ ও বাণিজ্যিকীকরণে সমস্যা রয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ ফল উৎপাদনও নিশ্চিত করতে হবে।

কাঁঠাল আমাদের খাদ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই প্রাচীনকাল থেকে
ছবি: মৃত্যুঞ্জয় রায়

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৮ হাজার ৭০০ হেক্টর জায়গায় কাঁঠালের চাষ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি জেলায় কাঁঠাল উৎপাদিত হলেও বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠাল উৎপাদনে শীর্ষে আছে পাঁচ জেলা। সেগুলো হলো গাজীপুর, বান্দরবান, রাঙামাটি, টাঙ্গাইল ও খাগড়াছড়ি।

কাঁঠাল যথেষ্ট সম্ভাবনাময় একটি ফল হলেও রপ্তানি খুবই কম হয়। এটাতে যদি ভ্যালু অ্যাড (মূল্য সংযোজন) করা যায়, তা হলে এর সম্ভাবনা আরও বাড়বে। বিশ্ববাজারে আমাদের প্রবেশ আরও সহজ হবে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের পরিচালক মশিউর রহমান

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. মইনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যেসব জায়গার মাটি লালচে ও একটু উঁচু, সেখানে কাঁঠালের উৎপাদন ভালো হয়। উৎপাদনে গাজীপুর শীর্ষে থাকলেও ময়মনসিংহের কাঁঠাল সবচেয়ে সুস্বাদু।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে কাঁঠাল উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে ভারত। দেশটিতে প্রতিবছর কাঁঠালের উৎপাদন হয় ২০ লাখ মেট্রিক টন। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার ১৩১ মেট্রিক টন কাঁঠাল, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬ হাজার ১৩১ টন বেশি।

বাংলাদেশ কেন রপ্তানিতে পিছিয়ে

কাঁঠাল উৎপাদনে ভারত শীর্ষে থাকলেও রপ্তানিতে এক নম্বর অবস্থানে আছে থাইল্যান্ড। ভারতের আমদানি-রপ্তানিবিষয়ক ওয়েবসাইট এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ডট ইনের তথ্য বলছে, থাইল্যান্ড প্রতিবছর ৭৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাঁঠাল ও কাঁঠালজাত পণ্য রপ্তানি করে থাকে। কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও উদ্যোক্তা তৈরির কারণে থাইল্যান্ড মূল্য সংযোজন করতে পেরেছে। তবে দেশটি কী পরিমাণ কাঁঠাল প্রতিবছর রপ্তানি করে, সে তথ্য পাওয়া যায়নি।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ওয়ান কান্ট্রি ওয়ান প্রোডাক্ট বা এক দেশ এক পণ্য (ওসিওপি) নামের একটি উদ্যোগ রয়েছে। এর আওতায় ২১টি দেশের অনন্য বৈশিষ্ট্যের ফলকে বৈশ্বিক বাজারে রপ্তানিযোগ্য করে তুলতে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ডট ইনের ভাষ্য, থাইল্যান্ড এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কাঁঠাল রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত কাঁঠাল রপ্তানি করেছে ২৬ হাজার ৬৬০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে একই অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে মাত্র ২ হাজার ৮১ মেট্রিক টন কাঁঠাল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংঘনিরোধ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন ও আয়ারল্যান্ডে কাঁঠাল রপ্তানি করে থাকে বাংলাদেশ।

বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠাল উৎপাদনে শীর্ষে আছে পাঁচ জেলা। সেগুলো হলো গাজীপুর, বান্দরবান, রাঙামাটি, টাঙ্গাইল ও খাগড়াছড়ি।

এফএওর ওসিওপি উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশের কাঁঠাল উৎপাদনের সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে ‘দ্য জ্যাকফ্রুট ভ্যালু চেইন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন ২০২৩ সালে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, দেশে কাঁঠালের উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প বা উদ্যোক্তা নেই। প্রক্রিয়াজাতকারী পর্যায়ে মূল্য সংযোজন মাত্র ১০ শতাংশ। এ ছাড়া কাঁঠাল থেকে অন্যান্য পণ্যের উদ্ভাবন ও বিপণনের অভাব রয়েছে।

কাঁঠাল থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ এখনো ক্ষুদ্র পরিসরে আছে। এ উদ্যোগের সুফল ভোক্তা পর্যায়ে কীভাবে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের পরিচালক মশিউর রহমান

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাঁঠাল থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের মান নিশ্চিত করা, সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রত্যয়ন ও ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে রপ্তানির সম্ভাবনা সীমিত হয়ে আছে। কাঁঠাল থেকে কমপক্ষে ৩০ ধরনের পণ্য তৈরি করা যায় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন উন্নত জাত, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ও সার প্রয়োগের মাধ্যমে কাঁঠাল চাষের গুণগত মান বাড়ানো, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁঠাল ও ভেজিটেবল মিটের বিকল্প হিসেবে এর প্রক্রিয়াজাত পণ্যের উপস্থিতি বাড়ানো, সরকারি ভর্তুকি যাতে কাঁঠালচাষিরা পান, তা নিশ্চিত করা।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের পরিচালক মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাঁঠাল যথেষ্ট সম্ভাবনাময় একটি ফল হলেও রপ্তানি খুবই কম হয়। এটাতে যদি ভ্যালু অ্যাড (মূল্য সংযোজন) করা যায়, তা হলে এর সম্ভাবনা আরও বাড়বে। বিশ্ববাজারে আমাদের প্রবেশ আরও সহজ হবে।’ তিনি বলেন, সারা বছর যাতে কাঁঠাল পাওয়া যায়, সে ধরনের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। দেশে এখন ছয় জাতের কাঁঠাল আছে।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত কাঁঠাল রপ্তানি করেছে ২৬ হাজার ৬৬০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে একই অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে মাত্র ২ হাজার ৮১ মেট্রিক টন কাঁঠাল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংঘনিরোধ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন ও আয়ারল্যান্ডে কাঁঠাল রপ্তানি করে থাকে বাংলাদেশ।

কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে হবে

কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফলের মর্যাদা পেয়েছে। প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে এ ফল থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে কাজ করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পোস্ট-হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ। এ বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা তৈরি করেছেন, যাঁরা গত এক বছরে ৬০ লাখ টাকার কাঁঠালের চিপস বিক্রি করেছেন। সম্প্রতি একটি এনজিও এক উদ্যোক্তার কাছ থেকে দুই টন ভেজিটেবল মিট কিনে নিয়েছে উল্লেখ করে গোলাম ফেরদৌস বলেন, এটা উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। ভেজিটেবল মিট দিয়ে তারা শিঙাড়া, সমুচা তৈরি করে রপ্তানি করবে।

বিএআরসির তথ্য অনুযায়ী, উদ্যোক্তাদের যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, মোড়কজাতকরণের সামগ্রী ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গুণগত মান নিশ্চিত করে কাঁঠালের চিপস, বার্গার, ভেজিটেবল মিট তৈরিতে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। দেশের ১০ জেলায় একটা পাইলট প্রকল্প চালু আছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রপ্তানির শীর্ষে রয়েছে আম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আম রপ্তানি হয়েছে ১৮ হাজার ৫৬৪ মেট্রিক টন। ওই অর্থবছরে আম উৎপাদিত হয়েছিল ২৫ লাখ ৯ হাজার টন। আমের পরেই কাঁঠালের অবস্থান।

বিএআরসির তথ্য অনুযায়ী, উদ্যোক্তাদের যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, মোড়কজাতকরণের সামগ্রী ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গুণগত মান নিশ্চিত করে কাঁঠালের চিপস, বার্গার, ভেজিটেবল মিট তৈরিতে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। দেশের ১০ জেলায় একটা পাইলট প্রকল্প চালু আছে।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, ‘কাঁঠাল থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ এখনো ক্ষুদ্র পরিসরে আছে। এ উদ্যোগের সুফল ভোক্তা পর্যায়ে কীভাবে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

জানা গেছে, এফএওর সহযোগিতায় স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ও এসিআই অ্যাগ্রো কাঁঠালের ভিনেগার ও হিমায়িত পণ্য তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। কাঁঠালের আচার মোটামুটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশা, এভাবে ধীরে ধীরে কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার ছড়িয়ে পড়বে।