বিজয়ের পথ—৩
বাঙালি সেনানায়কদের প্রথম সম্মিলিত বৈঠক
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এসেছিল কঠিন পথে; অসংখ্য মানুষের ত্যাগে ও সংগ্রামে, নানা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগে। গুরুত্বপূর্ণ সেসব ঘটনা নিয়ে এ আয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় তেলিয়াপাড়ার নাম খুব বেশি উচ্চারিত হয় না। হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার এই চা-বাগান যেমন সবুজ ছায়ায় লুকিয়ে আছে, অনেকটা তেমনি যেন ইতিহাসেও তেলিয়াপাড়া অন্তরালে। তার অস্তিত্ব নীরব।
হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরের নির্জন এই চা-বাগানেই হয়েছিল ঐতিহাসিক এক গোপন বৈঠক। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-তিন বইয়ের সূত্রে জানা যায়, তেলিয়াপাড়া চা-বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলোতে সেদিন বৈঠকে বসেছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৭ জন সেনা কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিকল্পনা নেন তাঁরা। গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের প্রথম সেনা সদর দপ্তর।
ওই বৈঠকে কারা ছিলেন, সেটাও একই বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বৈঠকে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী। ভারতের আগরতলা থেকে এসে তিনি ওই বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কাজী নূরুজ্জামান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিন প্রমুখ। তালিকাই বলে দিচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সেনানায়কদের বড় অংশই সেখানে হাজির ছিলেন।
ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সে বৈঠকে অংশ নেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল।
ওই বৈঠকে বাংলাদেশকে চারটি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলের সশস্ত্র যুদ্ধ চালাতে একজন করে সেনা কর্মকর্তা নির্বাচিত করা হয়। সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ‘এস ফোর্স’, খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ‘কে ফোর্স’ এবং জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ‘জেড ফোর্স’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে বড় ভূমিকা রেখেছিল। বৈঠকে রাজনৈতিক সরকার গঠনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই বৈঠক ছিল সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রথম সমন্বয় বৈঠক।
বৈঠকটি কেন তেলিয়াপাড়ায় আয়োজন করা হয়েছিল কিংবা বৈঠকে কী হয়েছিল—এসব জানতে হলে ফিরে যেতে হবে আরও কিছুদিন আগে।
কেন তেলিয়াপাড়া
২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলার পর থেকেই সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তারা বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধ করতে শুরু করেছিলেন। এসব বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধে যুদ্ধের পরিবর্তে সমন্বিত ও পরিকল্পিত যুদ্ধ পরিচালনার প্রয়োজন গভীরভাবে অনুভূত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সেক্টর এবং কে ফোর্স বইতে খালেদ মোশাররফ লিখেছেন, বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের সঙ্গে মেজর খালেদ মোশাররফ আলোচনা করেন। তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোতে বৈঠকের ব্যাপারে তাঁরা একমত হন।
তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের সঙ্গেই ছিল ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত একটি সীমান্ত ফাঁড়ি। পাহাড়ি অঞ্চলে চা-বাগানের ভেতরে হওয়ায় জায়গাটি ছিল কৌশলগত দিক থেকে নিরাপদ। মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ তাঁর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন, তেলিয়াপাড়া ছিল নিরাপদ এলাকা। সেখান থেকে নিরাপদে অভিযান চালানো এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব ছিল। সেখানে আবাসিক সুবিধাও ছিল।
ঐতিহাসিক সেই বৈঠক
বৈঠক শুরু হয় ৪ এপ্রিল সকাল ১০টায়, তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোতে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বাংলাদেশ সরকার গঠিত না হলেও বাস্তবতার প্রয়োজনে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসারের সদস্য এবং সাধারণ সশস্ত্র জনতাকে নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হবে। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধের সুবিধার্থে বাংলাদেশকে মোট চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হবে। চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা ও কুষ্টিয়া—এই চার অঞ্চলের নেতৃত্বে থাকবেন যথাক্রমে মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর আবু ওসমান চৌধুরী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-তিন বইয়ে বলা হয়েছে, বৈঠকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য ভারতের সাহায্য চাওয়া হয়। ভি সি পান্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতিক্রমে সে আশ্বাস দেন। আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল আশ্বাস দেন, ভারতীয় ভূখণ্ডে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং শরণার্থীশিবির স্থাপনে সহযোগিতা দেওয়া হবে।
বৈঠকে একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে এম এ জি ওসমানী নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এম এ জি ওসমানী এবং এম এ রবের নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধের নকশা প্রণয়ন এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ করানো হয়। শপথবাক্য পাঠ করান এম এ জি ওসমানী।
তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের বাংলোটিকে ৩ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। সে কারণে এর দখল নিতে পাকিস্তানি বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বইতে লিখেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী তেলিয়াপাড়া দখলে নিতে টানা ২১ দিন যুদ্ধ চালায়। অবশেষে ১৯ মে তেলিয়াপাড়ার পতন হয়।
বাংলোটি এখন কীভাবে আছে
মুক্তিযুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তেলিয়াপাড়ার যে বাংলোটিতে বসে নেওয়া হয়েছিল, সেটি এখনো চা-বাগানের ব্যবস্থাপকদের বাংলো। বাংলোর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটি স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ।
তেলিয়াপাড়ার ৪ এপ্রিলের সেই ঐতিহাসিক বৈঠকের একটি ভাস্কর্য রয়েছে মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে। ভাস্কর্যটি তেলিয়াপাড়ার সেই বাংলোতেই স্থাপনের কথা ছিল; পরে আর তা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বাংলোটিকে সংরক্ষণ করে জাদুঘরে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। তেলিয়াপাড়ার স্মৃতি সংরক্ষণ বলতে এখন প্রতিবছরের ৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস পালন ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই।
তথ্যসূত্র:
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-তিন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়
২. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম
৩. মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সেক্টর এবং কে ফোর্স, খালেদ মোশাররফ
৪. ১৯৭১: ভেতরে বাইরে, এ কে খন্দকার
৫. মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিসাক্ষী তেলিয়াপাড়া, মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার
৬. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড, মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহর সাক্ষাৎকার, সম্পাদনা: হাসান হাফিজুর রহমান