১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট রাত ১২টায় রাজশাহীতে বসে এক তরুণ লিখেছেন কলকাতার এক তরুণীকে। চিঠিতে দুজনের কারোরই নাম নেই। সম্বোধনের জায়গায় মেয়েটার ছবি। একইভাবে ছয় পাতার চিঠির শেষে নাম না লিখে ‘ইতি’র পরে ছেলেটা নিজের ছবি দিয়েছেন।
কলকাতার ফুটপাতের বইয়ের দোকানে বছর দেড়েক আগে একটি পুরোনো বইয়ের ভেতরে চিঠিখানা আবিষ্কার করেন সংগ্রাহক উজ্জ্বল সরদার। রাজশাহীতে সোমবার ও মঙ্গলবার দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত চিহ্নমেলায় উজ্জ্বল এনেছিলেন সেই চিঠি। নিছক প্রেমপত্র হলেও পড়ে বোঝা যায়, দেশভাগের কারণে মেয়েটা রয়ে গেছেন কলকাতায় আর ছেলেটা রাজশাহীতে। চিঠির ছত্রে ছত্রে সেই বিয়োগান্ত কথা ঘুরেফিরে এসেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শহীদ ইকবাল ২২ বছর ধরে সাহিত্যের ছোটকাগজ চিহ্ন সম্পাদনা করছেন। তাঁরই উদ্যোগে পঞ্চমবারের মতো আয়োজন ‘চিহ্নমেলা মুক্তবাঙলা’। দুই বাংলার লেখক, কবি, সংগ্রাহক, গবেষকদের এই মিলনমেলার প্রধান অতিথি ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। কলকাতার ৭০টি এবং বাংলাদেশের ১০০টি স্টলের সামনে দুদিন ধরে কাব্যপ্রেমীদের উপচেপড়া ভিড় লেগে ছিল। মঞ্চে কবিতা হলো, বাঁশি আর ঢোল বাজল, গাইল বাউল দল মাতাল।
মেলায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিল ‘কলকাতার কথকতা’ নামের একটি সংগ্রাহক দল। তাদের স্টলেই মিলল সেই চিঠি।
বইয়ের ভেতরে যেভাবে ভাঁজ করা ছিল, সেভাবেই রাখতে হয়েছে। কারণ, ৭৫ বছরের ব্যবধানে চিঠির কাগজ পাঁপড় ভাজার মতো মচমচে হয়ে গেছে। সবটা পড়া যায় না। খুলতে গেলেই ভেঙে যায়। উজ্জ্বল পলিথিনের জ্যাকেট পরিয়ে পরম যত্নে রেখেছেন অমূল্য এই চিঠিটিকে।
চিঠিতে মেয়েটার ছদ্মনাম ‘মিত্তি’ আর ছেলেটার নাম ‘মানা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সে সময় রাজশাহী বানানে দন্ত্যস লেখা হতো। চিঠিতে ওভাবেই লেখা। তারিখের জায়গায় ‘রাজসাহী, ১৫ই আগস্ট রাত বারোটা।’ ভেতরের আরেকটা পাতায় সাল লেখা ১৯৪৭।
ছেলেটা শুরুতেই লিখেছেন, ‘এখানে এসে অবধি তোমায় তিনখানা চিঠি লিখেছি, এটা হলো চতুর্থ। তুমি লিখেছ মাত্র একটা। তার জন্য অনুযোগ করব না।’ রাতের বেলায় খেয়ালমতো ঘুরে বেড়ানোর প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘হয়তো ভাবছো কেন আমি অন্ধকারের মধ্যে বেড়াতে যাই-তাই না! হ্যাঁ, তুমি অন্ধকার ভালোবাস বলেই যাই। তুমি অন্ধকারের মধ্যে কী এত খোঁজ!’
নিজের ঘরের বর্ণনা দিতে বলেছেন, এখানে আমার ঘরটা বড্ড বড়, আমার একার পক্ষে। পড়ার টেবিল, খাট, ড্রেসিং টেবিল। এ ছাড়া এত জিনিস আছে ঘরটার ভেতরে, তা–ও মনে হয়, একেবারে ফাঁকা।’ লিখতে লিখতে রাত একটা বেজে গেছে। আলো নিভে গেছে। ফ্যান বন্ধ হয়ে গেছে।
মোম জ্বালিয়েছেন। এই জায়গায় লিখেছেন, ‘বলতো, মোমের শিখায় এসে পোকাগুলো মরছে, এ দোষ কার, আলোর না পোকাগুলোর?—উত্তর পেলে কলকাতায় তুমি একদিন আমাকে কতগুলো কথা বলেছিলে, আমি তার উত্তর দিব।’ ছয় পাতার চিঠিতে জর্জ বার্নার্ড শর একটি নাটক সদ্য শেষ করে তার কয়েকটি সংলাপ ইংরেজিতে লিখেছেন, নিঝুম রাতের ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ, কলকাতার কোনো এক বেনুদার ঝগড়া, কাকে যেন ‘বেলুন’ সম্বোধন করে জানতে চেয়েছেন তার খবর। লিখেছেন আরও অনেক কিছু।
শেষাংশে লিখেছেন, ‘খুব পড়াশোনা করছো নিশ্চয়ই! আর আমায় ফেলে ফেলে বেড়াচ্ছোও নিশ্চয়-খুব।’ শেষে লিখেছেন, ‘প্রীতি নিও। ইতি।’ তারপরে শুধু নিজের ছবিটা লাগিয়ে দিয়েছেন।
এই স্টলে দেখা গেল দুর্লভ আরও অনেক কিছু। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া সত্যজিৎ রায় নির্মিত জয়বাবা ফেলুনাথ চলচ্চিত্রে ক্যাপটেনস পার্কের দাদুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিমল চট্টোপাধ্যায়। স্বয়ং তাঁর ছেলে চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এনেছেন সেই সিনেমার পোস্টার।
অনিন্দ্য সরকার আশ্চর্য সব ব্যাংক নোট দেখালেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম, মৃত্যু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার তারিখের সঙ্গে নোট তিনটির নম্বর হুবহু মিলে যায়।
দিনের গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে কলকাতার যুগান্তর পত্রিকা সন্ধ্যাবেলায় টেলিগ্রাম ইস্যু বের করত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর সন্ধ্যায় প্রকাশিত পত্রিকাটির টেলিগ্রাম ইস্যুর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘মুজিব কি নিহত?’ যুগান্তর–এর এই সংখ্যা মেলায় নিয়ে এসেছেন পত্রিকা সংগ্রাহক সোহেল চক্রবর্তী।
১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারতের যুগান্তর পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রথম মানচিত্র ছাপা হয়েছিল। সেই সংখ্যায় বাংলাদেশ বানান লেখা হয়েছে ‘বাঙলা দেশ’ এইভাবে। সংখ্যাটি মেলায় এনেছেন ফালগুনী দত্ত রায় (৬৩)।
মঙ্গলবার রাতে মেলার স্টল গোটানো চলছিল। মঞ্চে বাউলগান। পশ্চিমবঙ্গের ‘কবিতা সীমান্ত’র স্টলে শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত কবি সোমনাথ রায় বসেছিলেন একা। বললেন, অধ্যাপক শহীদ ইকবালের শক্তি হচ্ছে তাঁর ছাত্রদের ভালোবাসা। একজন মানুষ এত বড় মেলার আয়োজন করে দেখালেন, আজও শিক্ষকের সম্মান সবার ওপরে।