মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ জোরদার করে তার প্রদর্শন জরুরি: আ ন ম মুনীরুজ্জামান

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে শূন্যরেখার কাছাকাছি বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ১২০ মিটার ভেতরে গত শনিবার মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর দুটি গোলা বিস্ফোরিত হয়। এর আগে গত মাসে দুই দফায় মিয়ানমারের ছোড়া মর্টারের গোলার বিস্ফোরিত অংশ ও অবিস্ফোরিত গোলা বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে পড়ে। সে সময় এ ঘটনাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত’ উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। গতকালের ঘটনায়ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় তলব করেছে। এ নিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে তৃতীয় দফায় তলব করা হয় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কতটা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়, করণীয় কী হতে পারে—এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আ ন ম মুনীরুজ্জামান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমদুল হাসান

বিআইপিএসএসের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আ ন ম মুনীরুজ্জামান
ছবি: দীপু মালাকার

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কিছুদিন ধরে বেশি গোলাগুলি হচ্ছে। এটার কারণ কী?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বিভিন্ন সমস্যার কারণে মিয়ানমার সীমান্ত এখন সম্পূর্ণ স্থিতিশীল নয়। দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের ভেতরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যক্রমকে প্রতিহত করতে মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের সেনাবাহিনী বিভিন্ন অভিযান চালাচ্ছে। সেই অভিযানের জেরে কোনো কোনো সময় তারা বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে চলে আসছে বা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার অপচেষ্টা করছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে প্রতিহত করতেই মিয়ানমার এ ধরনের কাজগুলো করছে বলে আমার মনে হয়।
এখানে মূলত দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কাজ করছে। আরসা আগেও কাজ করেছে, এখনো করছে। তবে আরসা এখন আগের মতো শক্তিশালী নয়। এখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী যে সংগঠনটি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, সেটা হচ্ছে আরাকান আর্মি।

প্রশ্ন :

আরাকান আর্মির শক্তি কতটুকু? তাদের এখনকার অবস্থা কী, এ বিষয়ে কী কোনো খবর পাওয়া যায়?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: সাংগঠনিকভাবে এবং অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদির দিক থেকে আরাকান অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, তারা সে দেশের জনগণের বিপুল সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এর প্রতিফলন হচ্ছে, আরাকান আর্মি এখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আগের চেয়ে সাহসী অভিযান চালাচ্ছে। এটাকে প্রতিহত করতেই এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

প্রশ্ন :

এক বছর আগে আপনি প্রথম আলোর এক কলামে লিখেছিলেন, মিয়ানমার একটি বৃহৎ শক্তির প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। সেই আশঙ্কা কী জোরালো হয়েছে?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: প্রক্সি যুদ্ধের আলামত এই অভিযানে দেখা যাচ্ছে না। এই অভিযানে যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে, মিয়ানমারের যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তাদের প্রতিহত করতেই মিয়ানমার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময় তারা অভিযোগ করেছে, সংগঠনগুলো সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তারা এমনও অভিযোগ করছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তারা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করে। তবে আমরা এটা কখনোই মেনে নিইনি।

প্রশ্ন :

মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে গোলা ফেলছে। কিছু গোলা বাংলাদেশের ভেতরেও পড়ছে। এটাকে কী উসকানি বলবেন?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: প্রথমত, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এটাকে গ্রহণ করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সর্বোচ্চ জোড়ালো ভাষায় কূটনৈতিক পর্যায়ে এটার প্রতিবাদ জানাতে হবে। তৃতীয়ত, আমাদের সীমান্তে মোতায়েন করা সৈন্য বা অন্যান্য যে সংগঠনগুলো আছে, তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে আমাদের সীমান্ত সুরক্ষিত থাকে। তবে আমরা আশা করব এ ধরনের কার্যক্রম যেন এখানেই বন্ধ হয়ে যায়, এটার বিস্তৃতি লাভ না করে, যেন কোনো উসকানিমূলক কার্যক্রম এখানে সংঘটিত না হয়।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে। এ পরিস্থিতিতে একটি দেশের করণীয় কী?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আকাশসীমা এর আগেও মিয়ানমার বহুবার লঙ্ঘন করেছে। এখন তারা এটা ঘন ঘন করছে। এখানে শুধু প্রতিবাদ সেটা নয়, তারা আকাশসীমা লঙ্ঘন কড়লে তাদের তাড়িয়ে বের করে দিতে হবে। এখানে সামরিক পরিভাষায় যেটা বলতে চাই, সেটা হলো, প্রতিরোধের শক্তিগুলো আরও প্রদর্শিত হতে হবে, শক্ত হতে হবে। এটা না হলে এ ধরনের পরিস্থিতি আরও তৈরি হবে।

ডেট্রেন্স যদি পুরোপুরি কাজ করে তবে এ ধরনের কোনো অ্যাডভেঞ্চার বা আইন ভঙ্গ করে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে চিন্তা করবে বা নিবে না।

আমার মনে হচ্ছে এখন এ ধরনের ডেট্রেন্স কাজ করছে না। যার কারণে মিয়ানমার খেয়ালখুশি মতো তারা সীমান্ত অতিক্রম করছে, আকাশসীমা অতিক্রম করছে। তাদের গোলাবারুদ আমাদের সীমান্তের ভেতরে এসে পড়ছে। সব কটি আমাদের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। এর কোনোটাই হালকা করে নেওয়ার অবকাশ আছে বলে আমার মনে হয় না।

প্রশ্ন :

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বারবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এর বাইরে কী কিছু করার আছে?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এর বাইরে দুটি দেশের বর্ডার গার্ড বাহিনীর মধ্যে কিছু সংযোগ স্থাপন করেও জানানো যেতে পারে, এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য নয়। তার ওপর যেতে হলে আমাদের পাল্টা কিছু করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আশঙ্কা থাকে পাল্টা করতে করতে পরিস্থিতি অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আমরা কখনোই সংঘাত কামনা করি না, তবে আমাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যা কিছু করা দরকার, সেটা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

প্রশ্ন :

সংশ্লিষ্ট সীমান্ত এলাকায় মানুষ দুশ্চিন্তায় রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে করণীয় কী?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এ ধরনের পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার মানুষ সংঘাতের আশঙ্কা করে আরও দুশ্চিন্তায় থাকবে। যেটা এখন করতে হবে সেটা হলো, মানুষকে বোঝাতে হবে, আমাদের যে সঠিক পদক্ষেপগুলো নেওয়ার, সেগুলো আমরা নিচ্ছি। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যেসব কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে, সেগুলো প্রতিহত করতে শান্তিপূর্ণভাবে যেসব পদক্ষেপ এ পর্যায়ে নেওয়া যায়, সেগুলো নেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের বার্তা সীমান্তবর্তী বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যাতে তারা কিছুটা আশ্বস্ত হয়।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের কোনো আশঙ্কা করছেন কি না, এমন হলে আমাদের জন্য কী সামনে আরও বড় কোনো সংকট তৈরির আশঙ্কা সৃষ্টি করে?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের যে চিহ্ন প্রথমদিকে দেখা গিয়েছিল, সেগুলো আগের মতো প্রকট নয়। মিয়ানমারের জনগণ প্রথমদিকে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সেনাবাহিনীর ওপর যে চাপ সৃষ্টি করেছিল, সেটা তারা অনেকটা কমিয়ে নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে যারা বিদেশি সরকার গঠন করেছিল, সেটা বেশিদূর এগুতে পারেনি।

মিয়ানমার আন্তর্জাতিক যে চাপের মুখে ছিল, সেটি এখন অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে, আমার মনে হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দিকে সবার দৃষ্টি চলে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক চাপ অনেক শিথিল হয়েছে। কাজেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ আগের চেয়ে অনেক শক্ত হয়েছে। তাদের প্রতিহত করতে যে ক্ষেত্রগুলো স্থাপন করা হয়েছিল, অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো তারা নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের সক্রিয় কোনো চিহ্ন বা আলামত দেখতে পাচ্ছি না।