রূপপুরের ঋণের সুদাসল রুবলে চায় রাশিয়া

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রফাইল ছবি

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়া যে ঋণ দিয়েছে, তার সুদ ও আসল নিজেদের মুদ্রা রুবলে পেতে চায় দেশটি। এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সরকারকে পাঠিয়েছে রাশিয়া।

ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর পর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা ও বৈশ্বিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফট থেকে রুশ ব্যাংকগুলোকে বের করে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া এই প্রস্তাব দিল।

রাশিয়ার প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। তাদের পর্যালোচনা বলছে, চীনের মাধ্যমে এই লেনদেন করতে পারে বাংলাদেশ। তবে রুবলে ঋণের সুদাসল পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যয় ও ঝুঁকি বাড়তে পারে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব উত্তম কুমার কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রাশিয়ার প্রস্তাব পর্যালোচনা করছি। চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’

একাধিকবার মুদ্রা পরিবর্তন করতে গেলে বিনিময় মাশুল (কনভার্সন চার্জ) দিতে হয়। এই খরচ কে দেবে, কর্মপন্থায় তা স্পষ্ট করতে হবে। তিনি বলেন, বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আলী হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব

রাশিয়ার চিঠি

পাবনার রূপপুরে বাংলাদেশ যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে, তাতে ঋণ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। এটি উৎপাদনে যাওয়ার কথা ২০২৪ সালে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, রূপপুর প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের কিছু বেশি, যা বর্তমান বিনিময় হারে (ডলারপ্রতি ১০৫ টাকা ধরে) প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার সমান। রাশিয়া রূপপুরে ঋণ দিচ্ছে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার। এই ঋণের ৪৯৭ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে। বাকি ৬৪১ কোটি ডলার।

রাশিয়ার ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুধু সুদ এবং এর পর থেকে সুদ ও আসল বছর বছর কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

রূপপুরের ঋণ পরিশোধ নিয়ে রাশিয়া বাংলাদেশকে দুটি চিঠি দিয়েছে। প্রথম চিঠি দেওয়া হয় গত ২৩ জুন। এতে দুই দেশের মধ্যে সই করা আন্তসরকার ঋণচুক্তির (আইজিসিএ) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এরপর গত ১০ আগস্ট আরেকটি চিঠি দেয় রাশিয়া। এতে মার্কিন ডলার ও ইউরোতে লেনদেন নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রুবলে লেনদেনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

মুদ্রা পরিবর্তনের খরচ কে দেবে, সেটাই প্রশ্ন। যদি রাশিয়ার সরকার সেটা বহন করে, তাহলে বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি চিন্তা করতে পারে।
সেলিম রায়হান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক

রাশিয়ার প্রস্তাব হলো, রুবলে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার ও রুবলের বিনিময় হার হবে রুশ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিনিময় হার অনুযায়ী। প্রকৃত পরিশোধের তারিখের ১০ দিন আগের দরটি বিনিময় হার হিসেবে ধরা হবে।

রুবলকে ঋণ পরিশোধের মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করতে হলে দুই দেশ ২০১৩ সালে যে আন্তসরকার ঋণচুক্তি সই করেছিল, সেখানে কিছুটা সংশোধন আনতে হবে। ওই চুক্তিতে ঋণ পরিশোধে ডলারকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের কথা বলা হয়। তবে ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই সই করা চুক্তিতে ঋণ পরিশোধের জন্য ডলারের পরিবর্তে উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ কী প্রক্রিয়ায় ঋণ পরিশোধ করবে, তার ছকও চিঠিতে উল্লেখ করেছে রাশিয়া। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে তৃতীয় একটি দেশের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যে দেশটি হবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞামুক্ত। আবার মুদ্রাটিকে হতে হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের রিজার্ভ মুদ্রা (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস বা এসডিআর)।

আইএমএফের রিজার্ভ মুদ্রা তালিকায় এখন মার্কিন ডলার, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড স্টার্লিং, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনের ইউয়ান রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীনের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারে। চীনে অবস্থিত ব্যাংকে ইউয়ানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বা অ্যাকাউন্ট রয়েছে। রাশিয়ার উল্লেখ করা ছক অনুযায়ী, প্রথমে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো ডলার ইউয়ানে পরিবর্তন করে রাশিয়ার হিসাবে পরিশোধ করা হবে। চীন ইউয়ানকে রুবলে পরিবর্তন করে রাশিয়ায় পাঠাবে।

সমস্যা কোথায়

রাশিয়ার ঋণের সুদাসল রুবলে পরিশোধের ক্ষেত্রে সমস্যা দুটি: ১. কয়েক দফা মুদ্রা পরিবর্তনের ফলে যে বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে, তার দায় কে নেবে, তা ঠিক হয়নি। ২. রাশিয়ার মুদ্রার বিনিময় হার মার্কিন ডলারের মতো স্থিতিশীল নয়।

রাশিয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে ইআরডির মতামতে বলা হয়েছে, একাধিকবার মুদ্রা পরিবর্তনের ফলে ঋণের ব্যয় ও ঝুঁকি অনেক বাড়বে। জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একাধিকবার মুদ্রা পরিবর্তন করতে গেলে বিনিময় মাশুল (কনভার্সন চার্জ) দিতে হয়। এই খরচ কে দেবে, কর্মপন্থায় তা স্পষ্ট করতে হবে। তিনি বলেন, বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ঠিক করতে হবে সুদহারও

ইআরডির পর্যালোচনায় বলা হয়, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে ঋণচুক্তি হয়েছে লন্ডন আন্তব্যাংক সুদের হারের (লাইবর) ওপর ভিত্তি করে। ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে এই হার আর থাকছে না। বদলে প্রযোজ্য হবে আরেক হার, সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট (সোফর)।

ইআরডি বলছে, লাইবর ও সোফরের মধ্যে তারতম্য থাকায় রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদহারের সীমা নির্ধারণ করতে হবে। বিষয়টি বাস্তবায়নে উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত দরকার।

অবশ্য এখন পর্যন্ত বেশি আলোচনা হচ্ছে রুবলে লেনদেন নিয়ে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, মুদ্রা পরিবর্তনের খরচ কে দেবে, সেটাই প্রশ্ন। যদি রাশিয়ার সরকার সেটা বহন করে, তাহলে বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি চিন্তা করতে পারে।