সব রেখে চলে যায় মেয়েরা

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোতে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনার লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে—নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

‘ভালোবাসি, ইতি তোমার অঞ্জন।’

বইয়ের মলাট ওলটালেই শব্দ চারটি চোখে পড়ে। কালো কালিতে এলেবেলেভাবে লেখা। আর শেষে একটা স্বাক্ষর। ওইটুকু লেখার মধ্যেও তাড়াহুড়ার ছাপ যেন স্পষ্ট। হতে পারে নীলক্ষেতে সেদিন অনেক ভিড় ছিল। তাই ভীষণ অসুবিধায় দাঁড়িয়ে বইটিতে এই কথাগুলো লিখেছিল ছেলেটি। কিন্তু কিসের এত তাড়া ছিল তার? অবশ্য কোনো তাড়া না–ও থেকে থাকতে পারে। তবে অঞ্জন নামের কেউ একজন যে বইটা তাকে উপহার দিয়েছিল, তা ঢের বোঝা যাচ্ছে। তবে যাকে দিয়েছে, তার নাম নেই।

আমি হলে আমার রুমের তাকের ওপরে বইটা পেয়েছিলাম। আদতে এই একটা বই নয়। আরও বেশ কিছু গল্পের বই। সব কটাই ধুলায় মাখামাখি। পৃষ্ঠাগুলো হলুদ হয়ে গেছে। হয়তো অনেক বছর আগে কেউ ফেলে রেখে চলে গেছে। কেউ জানে না ওগুলো কার। কেউ হাতও দেয় না। আমি ওই রুমে যত দিন ছিলাম, সব কটি বই পরিষ্কার করে গুছিয়ে রেখেছিলাম।

ভেবে পাই না, কেন কেউ গল্পের বই ফেলে যাবে। তবে কি মেয়েটির বাড়িতে সাহিত্যের বই পড়া নিষিদ্ধ ছিল? তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাড়ার সময় সেগুলো আর বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়নি? নাকি চাকরি–বাকরি পেয়ে ব্যস্ত মেয়েটির গল্পের বই পড়ার সময় ছিল না? এত বছর পরে কেউ আর জানতে পারবে না কখনো, কেন বইগুলো তার কাছে গুরুত্ব হারিয়েছিল।

মিলনায়তনের বারান্দায় গেলেও ভীষণ অবাক হই। বেশ কিছু হারমোনিয়াম পড়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন বাইরে থাকতে থাকতে কভারে লাগানো তালাগুলোয় জং ধরে গেছে। সব কটা হারমোনিয়ামই কি নষ্ট? না হলে তালা লাগানো কেন? মিলনায়তনের বারান্দায় মেয়েরা রেওয়াজ করে নিত্যদিন। বন্দী হারমোনিয়ামগুলোও নিশ্চয়ই সুরের ছন্দে একসময় রোজ কেঁপে উঠত। কিন্তু কেউ কেন তার হারমোনিয়ামটা ফেলে রেখে চলে যাবে? গান গাইতে আর ইচ্ছা করেনি? নাকি যাওয়ার সময় হারমোনিয়ামটা সঙ্গে নেওয়ার অবকাশ পায়নি? নাকি মেয়েটার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল? শ্বশুরবাড়িতে হয়তো হারমোনিয়াম নিয়ে যাওয়ার অনুমতিই মেলেনি। এমন অসংখ্য প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ওই বারান্দায় চক্কর দিই।

লন্ড্রিতে গিয়ে দাঁড়ালেও মাথার ভেতরের পোকাটা নড়েচড়ে ওঠে। ধোপা দাদুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে জানা হয়ে যায়, বছরের পর বছর ধরে বেশ কিছু শাড়ি-জামা রয়ে গেছে তার কাছে। ধুতে দিয়ে কেউ আর নিয়ে যায়নি সেগুলো। এত দিনে হয়তো হল ছেড়ে চলেও গেছে সেই মেয়েরা, যারা শাড়ি আর জামাগুলো দিয়েছিল। কিন্তু কোনো মেয়ের কাছে শাড়ি তো ভীষণ প্রিয়।

সারাক্ষণ কীভাবেই না আগলে রাখে শাড়ি। যারা শাড়ি পরতে পারে না, তারাও কোনো অনুষ্ঠানে বা প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় শাড়ি পরার প্রচেষ্টায় মেতে ওঠে। নিজেকে শাড়িতে জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে অবিরত। হল ছেড়ে যাওয়ার সময় কি তাহলে শাড়িটা নিতে ভুলে গিয়েছিল?

হলের প্রতিটি রুমেই যেন এইসব ফেলে চলে যাওয়ার কাহিনি লেখা। কেউ তো ব্যক্তিগত ডায়েরিটাও সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলে যায়। নাকি ইচ্ছা করেই রেখে যায়? কৌতূহলবশত খুলে দেখলে তাতে পাওয়া যায় নিজেকে লেখা চিঠি কিংবা হরেক রকম রান্নার রেসিপি। মেয়েটি কি সব রান্না শিখে ফেলেছিল তাহলে? তাই আর ডায়েরিটা লাগবে না? আর নিজের অনুভূতির কথাগুলো? ওগুলোও কি মিথ্যা হয়ে গিয়েছিল?

শুধু বই, শাড়ি, ডায়েরি কিংবা হারমোনিয়ামই নয়, বিচিত্র সব জিনিসপত্র রেখে চলে যায় মেয়েরা। আমার রুমের বারান্দায় এখনো পড়ে আছে চমৎকার ফুলেল নকশা করা পয়সাভর্তি মাটির বড় একটা ব্যাংক। হয়তো দোয়েল চত্বরের শোপিসের দোকানগুলোর কোনো একটা থেকে কিনেছিল মেয়েটি। দিনের পর দিন সযত্নে পয়সাও জমিয়েছিল তাতে। পরে টাকাটা হয়তো নিয়ে গেছে, পড়ে আছে খালি ব্যাংকটা। এসবের কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি না। তাই মনের ভেতরের প্রশ্নবোধক চিহ্নটা উত্তরহীন পড়ে থাকে।

তবু খুবই জানতে ইচ্ছা করে এইসব জিনিসের পেছনের গল্পগুলো। জানতে ইচ্ছা করে কেন নিষ্প্রয়োজন হয়ে উঠল শাড়ি, বই, হারমোনিয়াম কিংবা মাটির ওই ব্যাংক। জানতে ইচ্ছা করে, সেই মেয়েটি প্রিয়জনের দেওয়া বই কেন ফেলে গিয়েছিল! তবে কি মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হয়নি তার অঞ্জনের?

আমি সেই মেয়েটিকে চেষ্টা করেও কল্পনা করে উঠতে পারি না। আমার চোখে শুধু ভেসে ওঠে উদ্‌ভ্রান্ত এক তরুণের মুখ, ‘ভালোবাসি’ লিখতে গিয়ে যে একদিন ভীষণ তাড়াহুড়া করেছিল।

  • তথাপি আজাদ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়