সন্দ্বীপ বদলাচ্ছে, সবার দিন কি ফিরবে

গত ২০ বছরে সন্দ্বীপে অনেক পরিবর্তন এসেছে। উন্নয়নের চিহ্নও অনেক স্পষ্ট। কিন্তু এই উন্নয়নের উল্টো চিত্রও রয়েছে।

মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ
ছবি: আলমগীর কবীর

সন্দ্বীপের অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক দূর থেকে দেখা যাবে, মনোরম জেটির সুঠাম শরীর যেন নির্ভয়ের বাণী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাদা আর জল ভেঙে ডাঙায় ওঠার সেই পরিশ্রম আর করতে হায় না। বড় জলযান যাকে অনেকেই ‘শিপ’ বলেন; প্রতিদিন একবার সন্দ্বীপ থেকে কুমিরায় (সীতাকুণ্ড) যাচ্ছে। দরিয়ার নিচ দিয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ এখন হাতের নাগালে সার্বক্ষণিক। শক্তপোক্ত কংক্রিটের পোশাক পরানো বেড়িবাঁধ মানুষের মনে আশা জাগাচ্ছে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্দ্বীপের প্রধান ঘাট গুপ্তছড়ায় নেমে কিছুদূর যেতেই এমন চিত্র দেখা গেল। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপ চট্টগ্রামের একটি উপজেলা। জেলা সদর থেকে নদীপথে দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। দুই দিনে এই দ্বীপ উপজেলা ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা, রাজনীতিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখন কেমন আছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট
ছবি: আলমগীর কবীর

রহমতপুর বাজারের মুদিদোকানি বরকত আলীর কথায়, ‘একানব্বই আর হবে না।’ সরকারি হিসাবে, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল দক্ষিণ চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে নিহত হয়েছিল ১ লাখের বেশি মানুষ।

এখন সন্দ্বীপের উন্নয়নে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইপিজেড) গড়ে তোলাসহ একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। কয়েক বছর আগে অনুমোদন দেওয়া ১০টি নতুন ইপিজেডের মধ্যে রয়েছে সন্দ্বীপ অর্থনৈতিক অঞ্চল। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ উপজেলায় ফেরি চলাচলের জন্য রুট চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। সীতাকুণ্ডের বাঁকখালী ঘাট থেকে সন্দ্বীপের গাছুয়া ঘাটে ফেরি চলাচলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গত বছর সেপ্টেম্বরে। ফেরিঘাটের জন্য সড়কের কাজ চলছে। ফেরির জন্য কমপক্ষে ১৮ ফুটের সড়ক দরকার, সেটাও হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।

রাস্তা পাকা হয়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি বসেছে। মার্কেটের পর মার্কেট। দোকানে দোকানে সয়লাব। পরিস্থিতি অনেকটা এমন যে, এক শ কদম পেরোলেই পাওয়া যায় দোকানপাট। টাইলসের দেয়াল দেওয়া উঁচু উঁচু বাড়ির সারি পাড়ায় পাড়ায়। জমির দাম শুনলে পিলে চমকে যাবে। মনে হবে ভুল শুনছি। দাম শুনলে মনে হবে যেন রাজধানীর কোনো এলাকার জমি।

মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপে সাগরের তল দিয়ে সাবমেরিন কেবল দিয়ে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ এসেছে। এর আগে প্রায় সব বাড়ির চাল বা ছাদেই সৌরবিদ্যুতের প্যানেল ছিল। এখনো এমন প্যানেল আছে কারও কারও। তবে সোলার প্যানেলের ব্যবসা প্রায় বন্ধ। বিত্তশালীদের উদ্যোগে স্থাপিত হচ্ছে নানা নকশা আর স্থাপত্যশৈলীর বেসরকারি স্কুল, ক্লিনিক। নতুন নতুন হাসপাতাল হবে এমন বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ল।

রেস্তোরাঁয় রেস্তোরাঁয় নাশতা কিনতে আসা মানুষের সারি। পাক্কা বাড়ির কেউই নাকি বাড়িতে নাশতা বানিয়ে খান না। ডিব্বা হাতে অনেকে বাড়ির ছোটদের পাঠিয়ে দেয় পাড়ার হোটেলে। অনেকে বলেন, ‘রেমিট্যান্স কালচার’। এ উপজেলার অনেকে এখন থাকেন প্রবাসে। তাঁরা নিয়মিত টাকা পাঠান।

নানা বিদেশি ফলে সেজে আছে ফলের দোকান। টাকা দিলে থাইল্যান্ডের বাতাবিলেবু থেকে কান্দাহারের আনার পাওয়া যাবে অনায়াসেই। প্রসিদ্ধ বিনয় ঘোষের মিষ্টির দোকানের বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। ঢাকার গুলশান, বারিধারা, বেইলি রোড আর সচিবালয়ে থাকেন তাঁদের ক্রেতারা। পার্সেলের ব্যবস্থা আছে।

সন্দ্বীপের এই পরিবর্তন গত ২০ বছরের। কিন্তু এসবই ‘কার্পেটের’ ওপর দিকের ছবি।

‘কার্পেটের’ নিচে আছে অন্য ছবি

লবণাক্ততা বাড়ছে। কৃষির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সেচব্যবস্থার তেমন কোনো চিহ্ন চোখে পড়ল না। আমন ছাড়া অন্য ফসল করে না কেউ। প্রতিবছর এখানে খাদ্যঘাটতি থাকে গড়ে ৫৭ হাজার ৩০৫ টন। এমনকি মাছ, ডিম, মুরগির জন্য দেশের স্থল ভূখণ্ডের সরবরাহের ওপর সন্দ্বীপ নির্ভরশীল। এখানকার কৃষকের ধান সরকারও কেনে না বলে জানা গেল। কোনো ধান ক্রয়কেন্দ্র আছে কি না, সেটা কেউ জানাতে পারল না।

মহিষের খামারিরা চোরের ভয়ে মহিষের সঙ্গে বাথানে জেগে থাকে। তুফানে ভেসে যায় মহিষের পাল। গত বছর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে জোয়ারের উচ্চতা বেড়ে গেলে অনেক মহিষ ভেসে সন্দ্বীপ থেকে সীতাকুণ্ড উপকূলে চলে যায়। সীতাকুণ্ডে গিয়ে মহিষের মালিকানা প্রমাণ বড়ই কঠিন কাজ। কেউ মানতে চায় না।

সন্দ্বীপে আদালত বসে কি বসে না, সেটা মাঝেমধ্যে কেউ বুঝতে পারে না। শিশু–কিশোরদের সুস্থ বিনোদনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই, দলছুট রোহিঙ্গারা চলে আসে সন্দ্বীপে।

সন্দ্বীপের চরে সন্দ্বীপবাসীর হিস্যা নেই। নতুন জেগে ওঠা ভূমি বন্দোবস্তের জন্য পদক্ষেপ না নিলে জট জটিলতর হবে। ভূমি বিরোধ জটিল হচ্ছে পাশের জেলার নোয়াখালীর সঙ্গে। মানুষ, গবাদি প্রাণী সবার চিকিৎসা–সুবিধা অপ্রতুল। বিদ্যুৎ এসে ‘খাম্বা বাণিজ্য’ শুরু হয়েছে। আলগা খরচ না করলে খাম্বা বাড়ির কাছে আসে না। দূরেই থেকে যায়। রাজনৈতিক জেলেদের হাতে জলমহল। জাল যার, জলা তার—সন্দ্বীপে যেন কেবলই এক রাজনৈতিক বুলি।

হাসপাতালের একমাত্র সরকারি অ্যাম্বুলেন্স অচল। তবে হাসপাতালকর্মীর কেনা অ্যাম্বুলেন্স থাকে ফিটফাট। টাকা দিলে অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাওয়া যায়। সরকারি দপ্তরে কর্মকর্তাদের না পাওয়ার কথা জানালেন অনেকে। দরিয়ায় নিরাপত্তা নেই। জলদস্যুরাই নাকি এখানকার ‘কোস্টগার্ড’। টিসিবির বিতরণব্যবস্থা এখানে নেই। আরও অনেক ভোগান্তি আছে কার্পেটের নিচে। তারপরও সন্দ্বীপের মানুষ কলিজা বড় করে বলতে পারে, ‘আন্নের গো বেগগুনের দাবাত সন্দ্বীপ আয়বেললাই...’। সন্দ্বীপে আসার জন্য আপনাদের সবাইকে দাওয়াত।