রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহ কম, দিনে জন্ম ৯৫ শিশুর

উখিয়ার বালুখালী এলাকায় সড়কের পাশে মায়ের কোলে শুয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে এক রোহিঙ্গা শিশুফাইল ছবি

কক্সবাজারে আশ্রয়শিবিরগুলোতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহ কম। এখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯৫টি শিশু জন্ম নিচ্ছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন এবং সম্প্রতি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দিন দিন রোহিঙ্গাদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। এটি ইতিবাচক।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে ৯০–এর দশকেও অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল।

বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এখন (৩১ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত হালনাগাদ) আশ্রয়শিবিরগুলোতে মোট নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৭০৭ জন। পরিবার আছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩০৩টি। এর মধ্যে ৩ শতাংশ পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১০ জনের বেশি। ১০ শতাংশ পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৮ থেকে ৯ জন। ২৩ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬ থেকে ৭ জন। ২৮ শতাংশ পরিবারে সদস্যসংখ্যা ১ থেকে ৩ জন। গড়ে প্রতি পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৫। আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫২ শতাংশই শিশু। তাদের বয়স শূন্য থেকে ১৭ বছর।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা ও স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়, রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতিদিন প্রায় ৯৫ জন শিশুর জন্ম হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ থেকে ১৩ লাখ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। জন্মহার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা শিবির এইচআইভি/এইডস, হেপাটাইসিস সি, ডিপথেরিয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এখন পর্যন্ত কক্সবাজার এলাকায় ৭১০ জন মানুষ এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৬১২ জন রোহিঙ্গা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬১ জন রোহিঙ্গা এইচআইভিতে মৃত্যুবরণ করে।

আরও পড়ুন

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্মহার বাংলাদেশিদের তুলনায় বেশি। জনসংখ্যা প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার বৃদ্ধি পায়। ২০২২ সালে সেটা কিছুটা কমেছে। তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। এখন আগের তুলনায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। প্রথম দিকে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে ৩০ শতাংশের ধারণা ছিল। এখন সেটা ৬৫ শতাংশ হয়েছে।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর বেশির ভাগ উখিয়ার কুতুপালংয়ে। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, এখানকার ক্যাম্প–৪ এক্সটেনশনে মোট ৮ হাজার ৭৮৩ জন রোহিঙ্গার বসবাস। এই ক্যাম্পে মোট পরিবার আছে ১ হাজার ৯৫১টি। ইউএনএইচসিআরের সহায়তায় এখানে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পরিচালনা করছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের আওতায় আছে ক্যম্প–৪ এক্সটেনশন। ক্যাম্পের কতজন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন, তার একটি মাসিক হিসাব রাখা হয় এই স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে। তাতে দেখা যায়, গত বছরের নভেম্বরে খাওয়ার বড়ি, কনডম, আইইউডি, ইমপ্ল্যান্টসহ বিভিন্ন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন ৬২২ জন। এর মধ্যে ৩২২ জন নারী খাওয়ার বড়ি ব্যবহার করেন। আর কনডম ব্যবহার করেন মাত্র ৩৬ জন পুরুষ।

গত বছরের ডিসেম্বর মাসে এসে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৫৭৭ জনে। তবে চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা আবার বেড়ে হয় ৭৫০। এর মধ্যে ৪৪৮ জন খাওয়ার বড়ি ব্যবহার করেন আর কনডম ব্যবহার করেন ৫৮ জন।

আশ্রয়শিবিরের ভেতরে (৩ নম্বর ক্যাম্প) একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন রোহিঙ্গা নারী হাছিনা। প্রতি রোববার ও সোমবার তিনি ‘হোম ভিজিটে’ যান। রোহিঙ্গাদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কেমন—এসব নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। হাছিনা প্রথম আলোকে বলেন, অনেকের বাচ্চাকাচ্চা বেশি। বলা যায় এটা রোহিঙ্গা সংস্কৃতি। এর সঙ্গে ধর্মীয় কারণও জড়িত। অনেকেই মনে করেন, যত বাচ্ছা হওয়ার তা হতে হবে। না হলে গুনাহ হবে। তবে এখন অনেকে সমস্যা বুঝতে পারছে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে ঘুরে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের নিবন্ধনকেন্দ্রে গিয়ে কথা হয় এক রোহিঙ্গা দম্পতির সঙ্গে। ছেলেটির বয়স ২২ বছর। মেয়েটির সবে ১৮। পাঁচ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। এখনই তাঁরা দুই সন্তানের মা–বাবা। আরও দুটি সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা আছে তাঁদের।

তবে সবাই যে বেশি বেশি সন্তান নিতে চায়, বিষয়টি এমন নয়। এখন যত দিন যাচ্ছে, আশ্রয়শিবিরে থাকার সমস্যা তত টের পাচ্ছে রোহিঙ্গারা। জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনা নিয়েও তাদের সচেতনতা বাড়ছে। খায়ের হোসেন নামের এক রোহিঙ্গা যুবক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পরিবারের মোট সদস্য আটজন। তিনি বিয়ে করেছেন, ছয় মাস বয়সী একটি বাচ্চা আছে। তিনি মোট তিনটি বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। কারণ, এখানে থাকার কষ্ট, জায়গাজমি নেই, ঘর খুব ছোট। এ অবস্থায় পরিবার আরও বড় করলে সমস্যা আরও বাড়বে।