বাংলাদেশের রাজনীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গণ–অভ্যুত্থানের পথ ধরে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবর্তন। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবি আন্দোলন ১৯৫২ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ও পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতিতে সে আন্দোলন পরিণতি পায়। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির ঐতিহাসিক বিজয়, বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আবার গণ-অভ্যুত্থান, পরবর্তী সময়ে যা জনযুদ্ধে রূপ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। দীর্ঘ ৮ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায় ১৯৯০ সালের নাগরিক অভ্যুত্থান।
২০২৪ সালের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের আগেকার গণ–অভ্যুত্থানের পরম্পরা এবং ১৯৭১ সালের জনযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার পুনরুজ্জীবন। আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে এই গণ–অভ্যুত্থান রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে। তবে এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির ব্যবধান বিরাট। কথা ছিল, আমরা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যাব। অথচ অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে তার বিপরীত। বিশেষত রাষ্ট্রীয় অধিকারহীন ও বর্ণবৈষম্যের শিকার বাংলাদেশের নমশূদ্র, দলিত, হরিজন ও চা–শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষভাবে সত্য।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। তবে চরম বৈষম্যের শিকার নমশূদ্র, দলিত, হরিজন ও চা–শ্রমিকদের জন্য কোনো কমিশন গঠিত হয়নি। এমনকি গঠিত কমিশনগুলোর কোনোটিতে এই বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কোনো প্রতিনিধি নেই। এই জনগোষ্ঠীর নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের (১৯০৪-৬৮) ধারণা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীর থেকে মুসলিম শাসকগোষ্ঠী নিম্নবর্গের প্রতি বেশি সহানুভূতিপ্রবণ হবে। বিগত ৭৮ বছর তাঁর ধারণার বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে গণ–অভ্যুত্থানের পরে অনেকেই বলেছিলেন, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ‘ওয়ান অব দ্য ফাউন্ডিং ফাদার্স’। তাতে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী ভিন্নতর কিছু আশা করেছিল।
২০১৫ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ৵মাত্রার মর্মবাণী হচ্ছে, ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়, সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নিম্নবর্গকে পেছনে রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ৵মাত্রা অর্জন করতে পারবে না। এই বোধ থেকে বাংলাদেশ সরকার ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ‘বৈষম্যবিরোধী আইন ২০২২’ বিল আকারে উপস্থাপন করে। তবে বিলটি জাতীয় সংসদে গৃহীত না হওয়ায় আইনে রূপান্তরিত হয়নি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে এই জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার অবসানের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও গত ৫৪ বছরে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
২০২৪ সালের জুলাই গণ–অভ্যুত্থান ছিল ৫৪ বছরের এই বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষে৵। সে লক্ষ অর্জনে নমশূদ্র, দলিত, হরিজন ও চা–শ্রমিকদের প্রতি বিরাজমান বৈষম্যের অবসান হওয়া একান্ত দরকার। বিশেষত জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই চিত্রের হেরফের হওয়ার কোনো আশা নেই। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে রিট পিটিশন (৯২১০/ ২০২৫) দায়ের করা হয়। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতিদ্বয় সন্তুষ্ট হয়ে গত ১ জুন রুলনিশি জারি করেন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কমিটি গঠন করে অনগ্রসর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিষয়ে তদন্ত করে সুপারিশমালা জমা দিতে আদেশ দেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত তদন্ত কমিটি গঠন করেনি।
অনগ্রসর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে বিরাজমান বৈষম্যের অবসানের বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ অনুসারে কালবিলম্ব না করে তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত।
যে দেশে আজও জাতের প্রশ্ন তুলে শ্মশানে শেষকৃত্যে বাধা দেওয়া হয়, স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয় না, হোটেলে খাবার পরিবেশন করা হয় না, সেলুনে চুল কাটানো হয় না, এমনকি চায়ের দোকানের কাপে চা পান করতে দেওয়া হয় না, সে দেশে বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের অপরিহার্য শর্ত এসব বৈষম্য দূর করা। তা না হলে বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ ফাঁকা বুলিতে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রায় দেড় কোটি বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অভাব-অভিযোগের কথা না শুনে দেশের বিরাট মানবসম্পদকে রাজনৈতিকভাবে অস্পৃশ্য রেখে দিল! বর্ণব্যবস্থার দুই হাজার বছরের অবদমন এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ৭৮ বছরের বঞ্চনার বিষয়ে কোনো কথাই থাকবে না জুলাই সনদে!
নমশূদ্র, দলিত, হরিজন ও চা–শ্রমিকদের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের রাজনৈতিক অবস্থানের ফলে সিলেট ও খুলনা বিভাগের অধিকাংশ অঞ্চল পূর্ব বাংলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়। ৭৮ বছর কেটে গেছে, কোনো শাসকগোষ্ঠী এই বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা রাখেনি। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ফসল নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও কথা রাখছে না। এ আচরণ কি রাষ্ট্রনায়কোচিত?
আমরা শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সতর্কবাণী স্মরণ করিয়ে দিতে পারি: ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’
উৎপল বিশ্বাস: সদস্য, জাতপাত বিলোপ জোট