পরীক্ষায় পাস করাটাই জীবনের মূল বিষয় নয়

‘চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী সম্মেলনে’ বক্তৃতা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। আজ রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনেছবি: প্রথম আলো

পরীক্ষায় একটি-দুটি বিষয়ে ফেল করা মানে পুরো জীবনটাই অকৃতকার্য হয়ে যাওয়া নয়, যেকোনো মানুষের জীবন ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে পার করতে হয়। পরীক্ষায় পাস করাটাই জীবনের মূল বিষয় নয়; বরং সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আরও বেশি চেষ্টা করতে হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে এবং সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে। তাহলেই স্বপ্নের শিখরে পৌঁছানো যাবে।
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত দিনব্যাপী ‘চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী সম্মেলনে’ উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন সরকারের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, এভারেস্টজয়ীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্টজনেরা। একই সঙ্গে অনেকে কিছু সুপারিশও তুলে ধরেন।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ফার্মগেটে অবস্থিত কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ব্যতিক্রমধর্মী এই অনুষ্ঠান। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষক মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২০০ জন এতে উপস্থিত হন। এ ছাড়া ঢাকা থেকেও অনেকে অংশ নেন। তাঁদের অনেকেই নিজেদের সমস্যা ও বিভিন্ন রকম সুপারিশ তুলে ধরেন।
সুপারিশের মধ্যে ছিল পরীক্ষার আগে প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা কার্যক্রমে সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, ফলাফল প্রকাশের পরপরই অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্যালয়ভিত্তিক অনুপ্রেরণামূলক কাউন্সেলিং সভার আয়োজন, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত করার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যয় কমিয়ে এনে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা চালু, বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষক বাড়ানো এবং প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা।

এ ছাড়া শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া এবং শিক্ষার্থীপিছু ন্যূনতম ৫০০ থেকে পর্যায়ক্রমে ১ হাজার টাকায় উন্নীত করা, সব বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা চালু করা, মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করা, বিদ্যালয় মনিটরিং শক্তিশালী করা এবং অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে, বিশেষ করে শিশুশ্রম এবং বাল্যবিবাহ রোধে অভিভাবকদেরও সচেতন করতে হবে।
সাধারণত এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়াসহ ভালো ফল অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। সেখানে অকৃতকার্যদের নিয়ে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান ছিল ব্যতিক্রম।

সম্মেলনে আসা অভিভাবক ও শিক্ষকেরাও নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানান। আজ রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

যা বললেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা

খাগড়াছড়ি থেকে আসা এক কিশোর বলে, সে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি ও গণিতে ‘খারাপ ফল’ করেছে। সে জানাল, তার বাবা কৃষিকাজ করেন আর মা গৃহিণী। সে একটি দোকানে কাজ করত; কিন্তু প্রাইভেট পড়ার উপায় ছিল না। শেষে এক মাস দোকানদার ছুটি দিলে সে সময় প্রাইভেট পড়েছিল। তার ভাষ্য, বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পড়ালেও ভালো করার জন্য প্রাইভেট দরকার।
নীলফামারী থেকে আসা এক মা বলেন, তাঁর মেয়ে ভালো ছাত্রী। কিন্তু সে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় গণিতে ফেল করেছে। তাঁর মেয়ে গণিতে ফেল করবে এটা তাঁরা ভাবতেও পারেননি। ফলে তাঁরা ভেঙে পড়েন। তাঁর সন্তান উপবৃত্তির টাকা পায়নি বলে জানান তিনি।  
এভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা তাঁদের সমস্যা ও সমাধানের কথা তুলে ধরেন।

অতিথিদের উৎসাহমূলক কথা

দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে বিকেলের পর্বের প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, জীবনটা হচ্ছে একটা অন্তহীন লড়াই। সাফল্য বা ব্যর্থতা এগুলো আপেক্ষিক বিষয়। এসবের জন্য হতাশ হওয়ার দরকার নেই; বরং এগিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। সাফল্যের জন্য কাজ করে যেতে হবে।
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, পরীক্ষায় অনেকেই পাস করতে পারে না; কিন্তু এর বহু বিকল্প আছে।
এম এ মুহিত বড় পর্দায় ছবি দেখিয়ে তাঁর এভারেস্ট জয়ের গল্প শোনান উপস্থিত শিক্ষার্থীদের। পর্বতের সঙ্গে জীবনের তুলনা করে তিনি বলেন, জীবনপথেও উঠতে হয়, নামতে হয়। পর্বতে ওঠার জন্য তাঁর ২৬টি অভিযানের কথা তুলে ধরে বলেন, তিনি ১২ বারই ব্যর্থ হয়েছেন। সফল হয়েছেন ১৪ বার। তাই স্বপ্ন দেখতে হবে; আর স্বপ্ন পূরণের জন্য ধৈর্য ধরে থাকতে হবে।

—এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭।
—৩ লাখ ৪১ হাজার ৪৪৪ শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি।
—৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি।

একই পর্বে সংগীতশিল্পী নকীব খান ও ফাহমিদা নবী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি গান গেয়ে শোনান। এই পর্বে সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বক্তব্য দেন।
এর আগে সকালের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এবং বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা বাড়ানো যায় কি না, সবাই যেন তা পায়, সেটি দেখা হবে।
উপস্থিত শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে গিয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, যারা পাস করতে পারেনি তাদের কোনো দোষ নেই। তিনি বলেন, ‘তোমরা একদম মন খারাপ কোরো না। আমাদের পড়াশোনার সিস্টেমটা ভালো না।’
ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উপস্থিতি যদি ৭০ শতাংশ হয়, তাহলে ফেল করার কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান।

সঞ্চালকের বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, লেখাপড়া ও পরীক্ষায় পাস করাটাই জীবনের মূল বিষয় না।
শিক্ষার্থীদের ভালো মানুষ ও দেশপ্রেমী হওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক।
এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপারসন অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সংস্কৃতিজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক প্রিয়সিন্দু তালুকদার। বক্তব্য শেষে বাঁশি বাজিয়ে এবং সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেন সংগীতশিল্পী (জলের গানের) রাহুল আনন্দ।