ডিজিটাল সিলেট প্রকল্প: ইন্টারনেট সুবিধা সচল নেই, ক্যামেরা অকেজো

৩০ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় সিলেট ও কক্সবাজারে বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা এবং সিলেটে নজরদারি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল।

  • সিলেট ও কক্সবাজারে কোথাও বিনা মূল্যের ইন্টারনেট চালু নেই।

  • আইপি ক্যামেরার একটি বড় অংশ অকেজো।

ফাইল ছবি

সাড়ে সাত কোটি টাকা ব্যয় করে পর্যটন নগরী সিলেট ও কক্সবাজারের বেশ কিছু এলাকায় বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। অপরাধী শনাক্তে ইন্টারনেট প্রোটোকলভিত্তিক (আইপি) ক্যামেরাও বসানো হয়েছিল। ২০২০ সালে এসব সেবা চালু হয়। অবশ্য দুই বছর না যেতেই ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ক্যামেরার একটি বড় অংশ অকেজো।

ইন্টারনেট সেবা চালু ও ক্যামেরা বসানো হয়েছিল বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ‘ডিজিটাল সিলেট সিটি প্রকল্পে’র আওতায়। এটি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সংস্থা। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। প্রকল্পটির কোনো কাজের সুফল এখনো পাওয়া যায়নি। তবে মেয়াদ দুই দফা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে যে উৎসাহ থাকে, তা সুফল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে থাকে না। কারণ, কেনাকাটায় প্রাপ্তিযোগের বিষয় থাকে।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সাবেক সচিব

‘ডিজিটাল সিলেট সিটি প্রকল্পের’ অধীনে মূলত তিনটি কাজ হওয়ার কথা—সিলেট শহরের কিছু এলাকায় বিনা মূল্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু, শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নজরদারি ক্যামেরা বসানো এবং সিলেট মেডিকেল কলেজে ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা (হেলথ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) চালু। একই প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারেও বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়।

প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইন্টারনেট সুবিধা চালু ও ক্যামেরা স্থাপনের পর তা এক বছর নিজেরা পরিচালনা করে বিসিসি। ২০২১ সালের শুরুর দিকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সিলেট সিটি করপোরেশন, সিলেট মহানগর পুলিশ এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (কউক)। প্রকল্প পরিচালক ও বিসিসির ব্যবস্থাপক (সিকিউরিটি অপারেশনস) মোহাম্মদ মহিদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প শুরুর আগে এগুলোর তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা কী হবে, বাজেট কী হবে, এ–সংক্রান্ত আলোচনা ও চুক্তি দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিলেট সিটি করপোরেশন, সিলেট মহানগর পুলিশ এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হয়েছিল।

বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে সিলেট সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কোনো মন্তব্য করেননি। আর সিলেট মহানগর পুলিশ বলেছে, তাঁরা অনুরোধের ভিত্তিতে কাজ বুঝে নিয়েছিল, চুক্তি হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজেট না থাকা এবং সফটওয়্যারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা ও নজরদারি ক্যামেরা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

ইন্টারনেট সুবিধা সচল নেই

বিসিসি বলছে, সিলেট পর্যটকদের শহর বিবেচনায় নগরের ৬২টি এলাকার ১২৬টি জায়গায় বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা ও ১১০টি জায়গায় আইপি ক্যামেরা বসানো হয়। একেকটি জায়গায় ২০০ জনের বেশি মানুষের একসঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকার কথা। ক্যামেরাগুলোর মধ্যে ১০টি অত্যাধুনিক, যাতে মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ (ফেস রিকগনিশন) এবং যানবাহনের নিবন্ধন নম্বর স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিহ্নিত করার সুবিধা রয়েছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রুহুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১ সালের মার্চে সিটি করপোরেশনের কাছে প্রকল্প হস্তান্তরের পর প্রায় এক বছর ইন্টারনেট সেবা চালু ছিল। ২০২২ সালের শুরুর দিকে তা বন্ধ হয়ে যায়। সিটি করপোরেশনের বাজেটস্বল্পতার কারণে এই সেবা চালু রাখা সম্ভব হয়নি। তাঁরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বাজেট চেয়েছেন।

সিলেটের মতো কক্সবাজারের সুগন্ধা, লাবনী পয়েন্টসহ কলাতলী এবং সার্কিট হাউস সড়কের প্রায় দুই কিলোমিটারের ৩৫টি জায়গায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু হয়েছিল বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে এই সেবা পুরোপুরি বন্ধ আছে। সম্প্রতি শহরের কলাতলী সড়কের হাঙর ভাস্কর্য মোড় থেকে কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মোড় পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার সড়কে ঘুরে কোথাও বিদ্যুতের খুঁটিতে স্থাপিত রাউটার চোখে পড়েনি।

কক্সবাজারে বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দেখভালের দায়িত্ব পায় কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তাদের সঙ্গে বিসিসির সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছিল। সেবাটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপনগর–পরিকল্পনাবিদ তানবীর রেজা প্রথম আলোকে বলেন, কিছু রাউটার গত বর্ষায় এবং কিছু উন্নয়নকাজের সময় নষ্ট হয়েছে। বাজেট নেই। বাজেট পেলে চালু হবে।

নজরদারি ক্যামেরা অকেজো

নজরদারি ক্যামেরার দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিলেট মহানগর পুলিশ বলছে, ১১০টির মধ্যে এখন এক-তৃতীয়াংশের মতো ক্যামেরা অকেজো। পুলিশ নিজেদের তহবিল থেকে মেরামত করে ৬৭টি ক্যামেরা সচল করতে পেরেছে। বাকি ক্যামেরা সচল করা ব্যয়বহুল, যা মহানগর ‍পুলিশের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।

সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি সিলেট মহানগর পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়নি। অনুরোধের ভিত্তিতে পুলিশ বিভাগ বুঝে নেয়। সে সময় ১১০টি ক্যামেরার মধ্যে বেশির ভাগই অকেজো ছিল। তিনি আরও বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। অকেজো ক্যামেরা ঠিক করার জন্য সিটি করপোরেশনকে বলা হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনেরও বাজেট নেই।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা চালু হয়নি

সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা চালুর জন্য ১৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে ডিজিটাল সিলেট সিটি প্রকল্পে। তবে কাজ এগোয়নি।

বিষয়টি নিয়ে গত ৩০ নভেম্বর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বিসিসির মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হয়। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণ, নেটওয়ার্ক স্থাপন, তথ্যভান্ডার (সার্ভার) বসানোসহ অনেক কাজই বাকি। প্রকল্পের পরিচালক মহিদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অংশটি প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনে যুক্ত হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণেও কাজ পিছিয়েছে।

কথা ছিল, ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা চালু হলে সেবাপ্রার্থীরা বাড়ি থেকেই অনলাইনে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে হাসপাতালের টিকিট সংগ্রহ করতে পারবেন। চিকিৎসকেরা ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যবস্থাপত্র লিখবেন। হাসপাতাল থেকে ওষুধ সংগ্রহের জন্যও আলাদা করে ব্যবস্থাপত্রের প্রয়োজন হবে না। রোগীর পুরো তথ্য ও রোগবৃত্তান্ত তথ্যভান্ডারে থাকবে, যা ভবিষ্যতে চিকিৎসার জন্য সহায়ক হবে।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, সার্ভার স্থাপন ও নেটওয়ার্কিংয়ের কাজ চলছে। আগামী জুনে তারা পরীক্ষামূলকভাবে কিছু বিভাগে এই কার্যক্রম চালু করবেন।

‘পেছনে প্রাপ্তিযোগ’

অবশ্য প্রকল্পটি নিয়ে দুটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে—১. সিলেট ও কক্সবাজারে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া এবং ক্যামেরা স্থাপনের মতো সাধারণ কাজের প্রকল্প বিসিসি কেন নিতে গেল। এটা কি সিলেট সিটি করপোরেশন, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অথবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিতে পারত না। ২. জনগণের অর্থ ব্যয়ে নেওয়া প্রকল্পের সুফল যখন জনগণ না পায়, তার দায় কে নেবে।

উন্নয়ন প্রকল্প বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে যে উৎসাহ থাকে, তা সুফল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে থাকে না। কারণ, কেনাকাটায় প্রাপ্তিযোগের বিষয় থাকে। তিনি বলেন, প্রকল্প শেষের পর যাঁদের তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাঁরা তো কাজটি নিজের বলে মনে করেন না। কারণ, সেখানে তাঁদের প্রাপ্তিযোগ নেই।