অগ্রাধিকার জ্বালানি ও বাণিজ্যে

৬ সেপ্টেম্বর দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির শীর্ষ বৈঠক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনে সহযোগিতা, ব্যবসা–বাণিজ্য বাড়ানো, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতের মতো বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবে। গত এক দশকে এ দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্কের ‘বিশেষ মাত্রা’ বজায় রেখে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ৫ সেপ্টেম্বর ভারতে যাচ্ছেন। পরদিন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেবেন। দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনা শেষে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোর পাশাপাশি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দুই দেশের সহযোগিতার প্রসঙ্গগুলো আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার–পরবর্তী পরিস্থিতি আলোচনায় আসবে।

নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের একে অন্যকে প্রয়োজন। সম্পর্কের ভবিষ্যতের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয় যাতে উভয়ের উপকারে আসে, সেটিতে গুরুত্ব দিতে হবে।
এম হুমায়ূন কবীর, সাবেক রাষ্ট্রদূত

রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হলে এ অঞ্চলে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি বাংলাদেশ তুলবে। এর বাইরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে দুই দেশ আলোচনা করবে। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক কালে মার্কিন-চীন বলয়ের প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গটি আলোচনায় উঠতে পারে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস প্রথম আলোকে বলেন, দুই প্রতিবেশী দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বাণিজ্য, জ্বালানি, পানিবণ্টন, সংযুক্তি ও নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পাবে।

বাণিজ্য ও জ্বালানি

অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব জোরদারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারত ‘সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা)’ সইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য দুই দেশ চুক্তি শুরুর বিষয়ে আলোচনা করতে চায়। দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা শেষে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত সেপা সই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চুক্তিটিতে দুই পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ করে যাতে সুষম হয় এবং পরস্পরের জন্য সুফল বয়ে আনে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা ভারতকে বেশি দিচ্ছি আর পাচ্ছি কম, এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে। কাজেই এই চুক্তি যদি একপক্ষীয় হয়, তবে এটি টেকসই হবে না।’

ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করা, পাট রপ্তানির ওপর ভারতের আরোপিত ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ শুল্ক অপসারণের প্রসঙ্গগুলো তুলবে ঢাকা—এমনটা আভাস দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় রেলে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে সরবরাহব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রেখেছিল ভারত। ভারত এবার প্রস্তাব দিয়েছে, চাল, গম, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করে, সেগুলোর চাহিদার বিষয়ে আগাম জানাতে হবে। ভারত নিজের চাহিদা মেটানোর পর বাংলাদেশের প্রয়োজনের বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখবে। দুই শীর্ষ নেতার আলোচনায় বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে।

জ্বালানি খাতে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতায় মনোযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক পরিসরে জ্বালানিসংকট থাকলেও ভারত সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের কাছে পরিশোধিত ডিজেল রপ্তানি করতে চায় ভারত। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সফরে অগ্রগতির সম্ভাবনা রয়েছে।

অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন

প্রতিবারের মতো এবারের শীর্ষ বৈঠকেও তিস্তার বিষয়টি বাংলাদেশ তুলবে। এর পাশাপাশি ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমারের পানিবণ্টনের রূপরেখা নিয়ে সমঝোতার বিষয়টি তুলবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া গত ২৫ আগস্ট যৌথ নদী কমিশনে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নতুন আটটি নদী নিয়ে পানিবণ্টনের কথা বলা হয়েছে। শীর্ষ বৈঠকে এ বিষয় আলোচনায় আসবে।

দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের পর সেচের জন্য কুশিয়ারা নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এ ছাড়া গঙ্গার পানির সদ্ব্যবহারে দুই দেশের যৌথ সমীক্ষার ঘোষণা আসতে পারে শীর্ষ বৈঠক শেষে।

নিরাপত্তা ও সীমান্ত ইস্যু

বাংলাদেশ ও ভারতের যেকোনো পর্যায়ের আলোচনায় সীমান্ত হত্যা এবং শান্তিপূর্ণ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা অন্যতম ইস্যু। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সীমান্ত হত্যা কমে এসেছে। বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলছেন, সীমান্তে নিরস্ত্র লোকজনের হত্যা পুরোপুরি বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ জোর দেবে। সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যাতে মানব, মাদক ও সব ধরনের চোরাচালান বন্ধ থাকে, সে প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে।

প্রতিরক্ষা ঋণের ব্যবহার

২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হয়েছিল। ওই সময় ঋণ চুক্তির আওতায় প্রতিরক্ষা খাতে বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল ভারত। তবে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ওই ঋণের সদ্ব্যবহার করেনি বাংলাদেশ।

এ বছর আগস্টের শুরুতে দিল্লিতে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ঋণচুক্তির ৫০ কোটি ডলারের ব্যবহার, যৌথভাবে সমরাস্ত্র উৎপাদনসহ সহযোগিতার নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, দিল্লিতে প্রতিরক্ষা সংলাপ এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সমরাস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের পর ঋণচুক্তির অর্থের ব্যবহারের বিষয়ে অগ্রগতি রয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকেও আলোচনা হতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের পরিবারের জন্য বৃত্তি

ভারত ২০০৬ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের বিশেষ কর্মসূচির আওতায় বৃত্তি দিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরের সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয়দের সম্মান জানাতে মুজিব স্কলারশিপ ফর ওয়ার ভেটারেনস ফ্যামিলি নামের বৃত্তি চালুর ঘোষণা দেবেন। ৭ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কয়েকজনের হাতে এ বৃত্তি তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, শুরুতে এ কর্মসূচির আওতায় মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে ১০০ এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ১০০ করে মোট ২০০ শিক্ষার্থীকে এ বৃত্তি দেওয়া হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে যথাক্রমে এককালীন ৫০০ এবং ১ হাজার ডলার করে দেওয়া হবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে।

টেকসই উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুরস্কৃত করবে দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট (টেরি)। সাবেক টাটা এনার্জি রিসার্চ ইনস্টিটিউট এখন টেরি নামে পরিচালিত হচ্ছে।

খসড়া সফরসূচি

সফরের খসড়া সূচি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ সেপ্টেম্বর দিনের প্রথম ভাগে ভারতে পৌঁছাবেন। ওই দিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হোটেলে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৬ সেপ্টেম্বর সকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। এরপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাজঘাটে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। পরে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একান্তে এবং প্রতিনিধি পর্যায়ে বৈঠক করবেন। এরপর দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তালিকায় থাকা সমঝোতা স্মারক সই হবে।

প্রধানমন্ত্রী ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেবেন। ওই দিন দুপুরে তিনি দিল্লি থেকে রাজস্থানে যাবেন। তিনি সেখানে আজমির শরিফ দরগাহে যাবেন। সেখানে মাজার জিয়ারত শেষে পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের একে অন্যকে প্রয়োজন। সম্পর্কের ভবিষ্যতের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয় যাতে উভয়ের উপকারে আসে, সেটিতে গুরুত্ব দিতে হবে।