হিজড়া-ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে কেন এত বিতর্ক

বিশেষজ্ঞরা বলছে, হিজড়া-ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে বিতর্কের মূল কারণ তাঁদের বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতাছবি: প্রথম আলো

ট্রান্সওম্যান (রূপান্তরিত নারী) জয়া সিকদার। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি পটুয়াখালীর বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আসতে বাধ্য হন।

ছোটবেলায় জয়াকে তাঁর বাবা বাইরে নিয়ে যেতে চাইতেন। কিন্তু তাঁর হাঁটাচলা কেন পুরুষালি নয়, তা নিয়ে তাঁকে নানা কথা শুনতে হতো।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালে স্কুলে হয়রানি-কটূক্তির শিকার হয়ে জয়ার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। মেয়ের জন্য সমাজে মুখ দেখাতে পারেন না—এ ক্ষোভে বাবা একদিন জয়ার মাকে মারধর করেন।

জয়া বলেন, সন্তানের কারণে সন্তানের সামনে মাকে বাবার মারধরের পর তো সন্তানের পক্ষে আর বাড়িতে থাকা সম্ভব হয় না।

কৈশোরে ঢাকায় পা দেওয়ার পর পদে পদে যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন হয়রানির সম্মুখীন হন জয়া। এই শহরে জয়া পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় একটি চাকরি চেয়েও পাননি।

পোশাক কারখানার নিরাপত্তাকর্মী জয়াকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তাঁকে সারা দিন বসিয়ে রেখেছিলেন। সেই নিরাপত্তাকর্মীই রাতে জয়াকে যৌনপীড়ন করেন।

একসময় জয়া এক ‘গুরুমায়ের’ আশ্রয়ে থাকতে শুরু করেন। হিজড়া যৌনকর্মীদের সঙ্গে তাঁকেও একই কাজ করতে হয়। জয়ার ভাষ্য, তিনি ক্ষুধার যন্ত্রণায় এই পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

জয়ার জীবনে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ঘটে যাওয়া ঘটনা এগুলো। তারপর তিনি কেয়ার বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) কাজ করেন। নেতৃত্ব বিকাশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পান তিনি। জয়ার এখনকার পরিচয়—তিনি একজন অধিকারকর্মী। তিনি ট্রান্সজেন্ডার মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করছেন।

জয়া জানান, তিনি যখন হিজড়া কমিউনিটিতে ছিলেন, তখন নিজেকে ‘হিজড়া’ পরিচয় দিতেন। এ সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার পর তিনি নিজেকে ট্রান্সওম্যান বা রূপান্তরিত নারী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন।

গত বছরের জুনে অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হিজড়া সুলতানা আহমেদ ওরফে সাগরিকা সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন। প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, নবম শ্রেণিতে ওঠার পর সুলতানা আর স্কুলে টিকতে পারেননি। আগের ক্লাসগুলোও তিনি নানা টিপ্পনীর মধ্য দিয়ে পার করেছেন। শেষমেশ তাঁকে বাড়ি ছাড়তে হয়। তিনি বর্তমানে ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘ’ নামের একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

ট্রান্সওম্যান সঞ্জীবনী সুধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এমফিল করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ট্রান্সওম্যান হিসেবে তিনি প্রথম দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠে এমফিল করতে যাচ্ছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেন সঞ্জীবনী। তিনি উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি অর্জন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ করে সঞ্জীবনী কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন পরিচালিত বান্দরবানের লামায় ছিন্নমূল শিশুদের স্কুলে নাচের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। করোনায় মারা যাওয়া মানুষের দাফন-সৎকারের কাজে তিনি স্বেচ্ছায় যুক্ত হন। ২০২১ সাল থেকে তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত।

সঞ্জীবনীর মতে, ট্রান্সজেন্ডাররা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন। বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো একসময় পরিবার তাঁদের মেনে নেয়। তবে এর আগে তাঁরা শিক্ষাসহ সবকিছু থেকে বঞ্চিত হন। বাড়ি ছাড়তে না হলে, সমাজ সহজভাবে মেনে নিলে তাঁদের জীবনে এত দুর্ভোগ নেমে আসত না।

জয়া, সুলতানা, সঞ্জীবনীরা এ সমাজে আছেন। কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলেই তাঁরা অদৃশ্য হয়ে যাবেন না। সবচেয়ে বড় কথা, ২০১৪ সালে সরকার ‘হিজড়া লিঙ্গ’কে স্বীকৃতি দেয়। সংবিধান অনুযায়ী, তাঁদের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার সমানাধিকার আছে। তারপরও তাঁদের নিয়ে কেন এত বিতর্ক?

এর উত্তরে নৃবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসকেরা বলছেন, মানুষের অজ্ঞতাই এ বিতর্কের মূল কারণ। সরকার শুধু স্বীকৃতি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা এই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা দেয়নি। যতটুকু দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তা-ও সঠিক হয়নি।

সম্প্রতি বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক খণ্ডকালীন শিক্ষক একটি অনুষ্ঠানে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে থাকা হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক পাঠের দুটি পাতা ছিঁড়ে ফেলেন। এ ঘটনার পর বিষয়টি অনেক দূর গড়ায়।

হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতাসহ বিভিন্ন শব্দ দিয়ে যে যাঁর মতো করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে।

এর আগে বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত নারী হো চি মিন ইসলামকে বক্তৃতা দিতে দেওয়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হওয়া ‘হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার কোটা’র বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন একদল শিক্ষার্থী।

অবশ্য গত ২৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী পাঠ্যবইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক পাঠটি নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাকে অপরাজনীতি করার একটি প্রয়াস বলে মন্তব্য করেন।

আরও পড়ুন

সংজ্ঞাগত জটিলতা

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তর হিজড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’ বাস্তবায়ন শুরু করে। ২০১৩ সালে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে তারা।

সরকারের এই নীতিমালা অনুযায়ী, হিজড়া শব্দের ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডার। নীতিমালায় বলা হয়, চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুসারে, ক্রোমোজমের ত্রুটির কারণে জন্মগত ‘যৌনপ্রতিবন্ধী’ ব্যক্তি, যাঁদের দৈহিক বা জেনেটিক কারণে নারী বা পুরুষ—কোনো শ্রেণিতেই অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সমাজে এই জনগোষ্ঠী হিজড়া হিসেবে পরিচিত। হিজড়া বলতে সমাজে যিনি হিজড়া হিসেবে পরিচিত, যিনি নিজেকে হিজড়া পরিচয় দিতে ইতস্তত বোধ করেন না, তাঁকে বোঝাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, ট্রান্সজেন্ডার হচ্ছে যাঁদের সেক্স (জৈবিক লিঙ্গপরিচয়) ও জেন্ডার আইডেনটিটি (লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক পরিচয়) আলাদা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা ২০২১ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর ওপর পিএইচডি সম্পন্ন করেন।

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, ট্রান্সজেন্ডার একটি পশ্চিমা পরিভাষা, যার বাংলা রূপান্তরিত জনগোষ্ঠী। কেউ যদি জন্মগত বৈশিষ্ট্য বা আইডেনটিটির বিপরীতে অন্য কোনো ধরনের আইডেনটিটিকে ধারণ করতে চান, তবে তিনি ট্রান্স-আইডেনটিটির মধ্যে নিজেকে শনাক্ত করতে পারেন। অন্যদিকে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্য। এর মধ্যে আছে জানকা, জানানা, ছিবড়ি, ভাবরাজ, কোতি। হিজড়া সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নানা ধরনের আচার। বৈচিত্র্যময় হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে রূপান্তরকামীর সংখ্যাও কম নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন ‘নৃবিজ্ঞানী এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যের বয়ান’ নামে একটি বই লিখেছেন। তাঁর মতে, ট্রান্সজেন্ডার হলেন তাঁরা, যাঁদের জন্ম থেকে প্রাপ্ত যৌনপরিচয় ও লিঙ্গীয় পরিচয় এক নয়। যেমন পুরুষ (Male) হয়ে জন্মগ্রহণ করলেই সবাই ‘ম্যান’ (Man) হবে, তা নয়। পুরুষ (Male) হয়েও কেউ কেউ ‘ওম্যান’ (Woman) বোধ করতে পারেন। ঠিক একইভাবে নারী (Female) হয়ে জন্মগ্রহণ করেও কেউ নিজেকে ‘ম্যান’ (Man) ভাবতে পারেন। তাঁদের অনেকেই (সবাই নয়) হিজড়া সংস্কৃতিতে বড় হয় বলে তাঁদের ‘হিজড়া’ বলা হয়। যাঁরা লিঙ্গ পরিবর্তন করেন, তাঁরা ‘ট্রান্সসেক্সচুয়াল’।

জোবাইদা নাসরীন বলেন, হিজড়া আসলে কোনো পরিচয় নয়। এটি একটি সংস্কৃতি, একটি গুরুপরম্পরা সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিতে বিভিন্ন যৌন ও লিঙ্গীয় পরিচয়ের লোকজন বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নারী-পুরুষদের বাইরে লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের জনগোষ্ঠী ‘হিজড়া’ হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তান অনেক আগেই ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে এই জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি ২০১৬ সালে পাকিস্তান শরিয়াহ বোর্ড ট্রান্সজেন্ডার বিয়ে বৈধ বলে ঘোষণা দেয়। তবে কয়েকটি ইসলামপন্থী দল এ নিয়ে রিট করায় বিষয়টি এখনো কার্যকর হয়নি।

আরও পড়ুন

লিঙ্গবৈচিত্র্যের উপস্থিতি

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাভারত, রামায়ণে উল্লেখযোগ্যভাবে বৈচিত্র্যময় মানুষের উপস্থিতি আছে। মুঘল সম্রাট বাবরের সময় ‘নাজির’ হিসেবে রাজদরবারে এই মানুষদের উপস্থিতি ছিল। তবে ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলের লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর ওপর আরোপ করা হয় ‘ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট ১৮৭১’। এতে বলা হয়, যদি কোনো পুরুষ ‘মেয়েলি আচরণ’ করে, মেয়েদের মতো পোশাক পরিধান করে, প্রকাশ্যে মেয়েদের পোশাক পরে নাচগান করে, তবে তাকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে।’

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা আরও বলেন, ১৯৪৭ সাল-পরবর্তী পাকিস্তানে এই ধারা অব্যাহত থাকে। আইয়ুব খানের শাসনামলে তাঁদের (হিজড়া) রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করা হয়। একপর্যায়ে হিজড়া নেতারা আইয়ুব খানের বাসার সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেন। তাঁরা আইয়ুব খানের মায়ের কাছে আবেদন করেন, যাতে তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈধ ঘোষণা করা না হয়। মায়ের অনুরোধে আইয়ুব খান নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। স্বাধীন বাংলাদেশে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি সংস্থা ও পশ্চিমা দাতা সংস্থার আগ্রহে এইচআইভি/এইডস প্রসঙ্গে এই জনগোষ্ঠীকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। এর ফলে এই জনগোষ্ঠী আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন

কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ

২০২২ সালের মার্চে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, হিজড়া জনগোষ্ঠীর আত্মমর্যাদা ও সম্মানজনক সামাজিক জীবনযাপন নিশ্চিতে কাজ করা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির বাড়িভাড়ার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। সাধারণত কোনো বিশেষ শ্রেণির সংস্থা করছাড় পেলে পরবর্তীকালে একই ধরনের অন্য সংস্থাগুলোও এ সুবিধা পায়। বর্তমানে যেকোনো স্থান-স্থাপনা ভাড়ার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়।

বাজেটে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য করসুবিধা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে।

কোনো প্রতিষ্ঠান তার জনবলের ১০ শতাংশ বা কমপক্ষে ১০০ জন কর্মী এই জনগোষ্ঠী থেকে নিয়োগ দিলে প্রতিষ্ঠানের করপোরেট করে ৫ শতাংশ ছাড় বা ওই কর্মীদের পরিশোধিত বেতনের ৭৫ শতাংশ—এই দুইয়ের মধ্যে যেটি কম, তা প্রযোজ্য হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তিতে ট্রান্সজেন্ডার/হিজড়া কোটা চালু করে। এ প্রক্রিয়ায় কোটা শনাক্তে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের দেওয়া হিজড়া পরিচয়পত্র দাখিলের কথা বলা হয়েছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপপরিচালক এবং খসড়া আইন প্রণয়ন কমিটির সদস্য এম রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ট্রান্সজেন্ডারের সঙ্গে সমকামিতাকে যুক্ত করা, বিষয়টিকে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করানোর যে চেষ্টা, তা হচ্ছে মূলত এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে সঠিক জ্ঞানের অভাবে। এই জনগোষ্ঠীর অধিকার, মানবাধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব (সামাজিক নিরাপত্তা অধিশাখা) এবং খসড়া আইন প্রণয়ন কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মোক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত করতে কমিউনিটি পরামর্শ করা হবে। পাশাপাশি চূড়ান্ত খসড়া অনলাইনে দেওয়া হবে, যাতে সবাই মতামত দিতে পারেন। এ খসড়া আইনে উত্তরাধিকার সম্পত্তি, মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতিতে যাতে লাশ দাফন বা সৎকারে বেগ পেতে না হয়—এমন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের অধিকার সুরক্ষা দেবে আইনটি।

আরও পড়ুন

হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার শনাক্তে বিভ্রান্তি

সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচিতে জবাবদিহি-স্বচ্ছতা আনার জন্য হিজড়াদের ডেটাবেজ তৈরির কথা ছিল। ‘হিজড়াত্ব’ চিহ্নিতকরণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং শহর এলাকায় সিভিল সার্জনের সুপারিশের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কর্মকর্তা ও উপপরিচালক নিবন্ধন, পরিচয়পত্র দেবেন বলে নীতিমালায় উল্লেখ ছিল। নিবন্ধন বই সংরক্ষণ, তালিকা হালনাগাদ করাসহ বিভিন্ন কাজ করার কথা ছিল। তবে বিভিন্ন জটিলতায় পড়েছে হিজড়া ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ ও পরিচয়পত্র দেওয়ার কার্যক্রম।

২০১৮ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে নির্বাহী এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন রাজবাড়ীর ট্রান্সজেন্ডার নারী তানিশা ইয়াসমীন চৈতি। বর্তমানে তিনি রাজবাড়ীতে বিউটি পারলার পরিচালনা করছেন।

হিজড়াদের কল্যাণ ও পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। পরে তা স্থগিত করা হয়। তানিশা বলেন, নিয়োগপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মেডিকেল পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে তিনিসহ মোট ১৪ জন উপস্থিত হয়েছিলেন। এ পরীক্ষায় তানিশা পুরুষ হিসেবে শনাক্ত হন। অথচ তিনি হিজড়া হিসেবে পরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। শিক্ষা উপবৃত্তি পেয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অব ডিজিজের একাদশ সংস্করণে ট্রান্সজেন্ডারকে কোনো রোগ হিসেবে অভিহিত করা হয়নি। অর্থাৎ এই জনগোষ্ঠী মানসিক রোগী নয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক (চাইল্ড, অ্যাডলসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি) হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি-তুমি’ ছাড়াও এই সমাজে ‘সে’ বলতে যে কেউ থাকবে, তা শিশুদের শেখাতে হবে। এতে এই জনগোষ্ঠীর প্রতি শিশুদের সম্মানবোধ তৈরি হবে। সব মিলিয়ে সমাজকে শিক্ষিত হতে হবে।

হেলাল উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের অধ্যায়টি পর্যালোচনার জন্য পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এই কমিটিতে নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ চিকিৎসক রাখা হয়নি। হিজড়া কমিউনিটির কাউকে কমিটিতে রাখা হয়নি।

যৌনতা, যৌনপরিচয় ও লিঙ্গবৈচিত্র্য বিষয়ের গবেষক জোবাইদা নাসরীনের মতে, গেজেটে ‘হিজড়া লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় মূল সমস্যাটা শুরু হয়েছে। হিজড়া কারা, তা খোলাসা করা হয়নি। এ ছাড়া গেজেট করা, বাজেটে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো বা পাঠ্যপুস্তকে বিষয়গুলো থাকলেই হবে না; এই জনগোষ্ঠীকে মানুষ যাতে মেনে নিতে পারে, সে ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আলোচনা, কর্মশালার মতো কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে ছেড়ে দিলেই হবে না। এই জনগোষ্ঠীর জন্য হলগুলোর ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, তার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে বিতর্ক চলতেই থাকবে।