দেশটাকে ভালোবেসে ফেলেছি

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোতে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনার লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে—নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

প্রতীকী ছবি

৩১ জানুয়ারি ২০২০। ঘড়িতে তখন রাত ৮টা ১৫ মিনিট। উড়োজাহাজের চাকা সবে কোপেনহেগেনের মাটি স্পর্শ করেছে। জীবনে এটাই প্রথম দেশের সীমানা পেরোনো। তা-ও ঢাকা থেকে সাত হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরের দেশ ডেনমার্কে। আনুষ্ঠানিকতা সেরে বিমানবন্দর থেকে বেরোতে ৯টা বেজে গেল। পরের গন্তব্য ওডেন্স রাজ্যে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কোপেনহেগেন থেকে ট্রেনে যেতে হবে। বিমানবন্দরের ভেতরেই নতুন সিম কিনেছি। কিন্তু কারিগরি সমস্যায় সিম চালু করা যায়নি। দোকানদার বলে দিয়েছেন, কীভাবে আর কোথায় গিয়ে ট্রেনের টিকিট কাটতে পারব। এখানে লেনদেন সবই কার্ডের মাধ্যমে। আমি একজনের সহায়তা নিয়ে নগদ অর্থে টিকিট কিনলাম।

ওডেন্সের দূরত্ব ১৬৭ কিলোমিটার। সময় লাগে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট। ওডেন্সে পৌঁছালাম রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ। সিম চালু করতে না পারায় স্থানীয় একজনকে ঠিকানা দেখিয়ে সেটা কোথায় জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, মেট্রোরেলে তিন স্টেশন পরে এই জায়গা। ওনার সঙ্গে মেট্রোতে চড়ে বসলাম। যাত্রী আমরা দুজনই। উনি দুই স্টেশন পরে নেমে গেলেন। লাগেজ নিয়ে আমি নামলাম পরের স্টেশনে।

দৌড়ে গিয়ে মেট্রোচালককে ঠিকানা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কোথায়? তিনি বললেন, এক স্টেশন আগেই এই জায়গা রেখে এসেছ। পাঁচ মিনিট পর উল্টো দিকে আরেকটি মেট্রো আসবে। সেটায় চড়ে এক স্টেশন পেছনে চলে যেয়ো। আমিও তাঁর কথামতো লাইন পেরিয়ে নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

ঘড়িতে ততক্ষণে রাত ১১টা। পুরো স্টেশনে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। প্রচণ্ড শীত। চারপাশে সুনসান নীরবতা। এখন কী করব বুঝতে পারছি না। পাশেই ছোট্ট একটা কাচের ঘরে দুটি বেঞ্চ পাতা। ভাবলাম, শীতের রাতটা বেঞ্চে শুয়ে কাটিয়ে দিই। সকালে কোনো একটা ব্যবস্থা করে হোস্টেলে যাওয়া যাবে। লাগেজ পাশে রেখে, হাতের ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে বেঞ্চে শুয়ে পড়লাম। এর মাঝেই তুষার পড়া শুরু হয়েছে। মাথায় টুপি আছে। তিনটা জ্যাকেট আর তিনটা প্যান্ট পরেছি। এরপরও শীতে কাবু হওয়ার দশা।

রাত ঠিক তিনটা। হঠাৎ একটি গাড়ি স্টেশনে এসে থামল। আমি শব্দ শুনে কাচের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমাকে দেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত রাতে প্রচণ্ড শীতে তুমি একা স্টেশনে কী করছ?’ বললাম, আমি আজই এ দেশে এসেছি। সিম চালু করতে পারিনি। ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছি না। ভদ্রলোক বললেন, ‘চিন্তা কোরো না। আমার কাজ সেরেই তোমার একটা ব্যবস্থা করছি।’ আমার মনে হলো, এই নির্জন শীতের রাতে সাক্ষাৎ সৃষ্টিকর্তা যেন আমার উপকার করতে এসেছেন।

কথা বলে জানলাম, তিনি স্থানীয় সিটি করপোরেশনের একজন কর্মী। মিনিট দশেক পর তাঁর কাজ শেষ হলো। জানতে চাইলেন, ‘যদি পুলিশকে ফোন দিই, তাহলে কি তোমার কোনো সমস্যা আছে?’ আমি বললাম, না, কোনো সমস্যা নেই।

এরপর তিনি পুলিশকে ফোন করলেন। আমার সমস্যার কথা বিস্তারিত খুলে বললেন। পুলিশ জানাল, ছেলেটাকে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে চলে আসো। ভদ্রলোক আমাকে গাড়িতে বসালেন। আমার লাগেজ নিজের কাঁধে গাড়িতে তুললেন। পরে পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে দিলেন। বললেন, ‘আমাদের দেশে স্বাগত। চিন্তা নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমাকে এখন চলে যেতে হচ্ছে। এ জন্য দুঃখিত।’

আমিও তাঁকে বললাম, আমাকে সাহায্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনাকে কখনোই ভুলব না। এরপর তিনি পুলিশের কাছে আমাকে সঁপে দিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিলেন। পুলিশ আমার পাসপোর্ট দেখল। জিজ্ঞেস করল, আমি কেন ডেনমার্কে এসেছি। বললাম, পড়াশোনা করতে এসেছি। ভার্সিটির নামও বললাম। ঠিকানা দেখালাম।

এরপর আমার অবাক হওয়ার পালা। একজন পুলিশ সদস্য বললেন, ‘আমাদের দেশে স্বাগত। শিগগিরই তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ এরপর নিজেরাই আমার লাগেজ কাঁধে নিয়ে গাড়িতে তুললেন। ব্যাগ নিতে এলে আমি বললাম, এটা আমি নিজেই তুলতে পারব। জবাবে বললেন, ‘এটা আমাদের কাজ। আর তুমি অনেক পথ ভ্রমণ করে এসেছ।’

পুলিশের মুখে এ কথা শুনে আমি রীতিমতো অবাক। এরপর অন্ধকারের মধ্যে লাল-নীল বাতি জ্বালিয়ে পুলিশের গাড়ি ছুটল আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। ১০ মিনিটের মধ্যে আমাকে লাগেজসহ একদম হোস্টেলের রুমে পৌঁছে দিল। বিদায়বেলায় একজন বললেন, ‘স্যার, আমরা দুঃখিত, আপনার সঙ্গে এমন ঘটেছে। আশা করি আমাদের দেশে থাকার সময়টা উপভোগ করতে পারবেন। এখন আমরা আসি।’ আমিও বললাম, আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।

সত্যি অসাধারণ এক দেশ ডেনমার্ক। দেশটিতে আসার প্রথম দিনেই এমন বিড়ম্বনা আর তা থেকে মুক্তি পেতে সবার এমন সহযোগিতার হাত বাড়ানোর অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আসতে না আসতে আমি দেশটাকে ভালোবেসে ফেলি।

  • ঝুটন চৌধুরী, ওডেন্স, ডেনমার্ক