নানা অপকর্মে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, শাস্তি হয় না কারও
তিন মাসে অন্তত ১০টি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নাম এসেছে। প্রশাসন বলছে, লিখিত না পাওয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুচ্ছ ঘটনায় সহপাঠী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিকে মারধর, চাঁদাবাজি, তুলে এনে মুক্তিপণ আদায়ের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের নাম। তবে ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা বিচার না চাওয়ায় ব্যবস্থা নিতে পারেন না বলছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
গত তিন মাসে অন্তত ১০টি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের নাম আলোচনায় এসেছে। গত ২৫ জুলাই সাভার থেকে আশুলিয়া রুটে চলাচলকারী লেগুনা থেকে দৈনিক ২৫ টাকা হারে চাঁদা দাবি করে ২৪টি ক্যাম্পাসে আটকে রাখার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল ফারুক ইমরান, শাহ পরাণ ও হাসান মাহমুদ ফরিদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, লেলিন মাহবুব এবং উপছাত্র–বৃত্তিবিষয়ক সম্পাদক আল-রাজি সরকারের বিরুদ্ধে। তবে ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা লেগুনাগুলো আটকেছেন।
এসব শিক্ষার্থী অসংখ্য অপরাধ করে পার পেয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে।পারভীন জলী, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ
এর আগে গত ১ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী পানধোয়া এলাকার ডিশ ব্যবসায়ী মমিনউল্লাহর কাছে দাবি করা পাঁচ লাখ টাকা না পেয়ে লাইনম্যান খায়রুলকে ক্যাম্পাসে এনে মারধরের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক হাসিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। ৫ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী ইসলামনগর বাজারে এক জুতার দোকানদার ও তাঁর কর্মচারীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাব্বির হোসেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদি হাসানের বিরুদ্ধে।
৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী পাথালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ার হোসেনকে তুচ্ছ ঘটনায় মারধরের অভিযোগ ওঠে তাঁদের বিরুদ্ধে। সায়েম হাসান নামের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী কানে অস্ত্রোপচার করায় ১৬ মে ছাত্রলীগের গেস্টরুমে যাননি। এ কারণে শহীদ সালাম-বরকত হলের পলিটিক্যাল ব্লকে ডেকে নিয়ে তাঁকে হল ছাত্রলীগের নেতারা মারধর করেন। পরদিন রাতে তাঁকে আবার গেস্টরুমে ডেকে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে মারধর ও মাদক দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মী। ২২ মে এ ঘটনায় প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর ওই হলের ছাত্রলীগের আট নেতার নামে আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী।
১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাঙামাটি এলাকার বাসিন্দা ফরিদ হোসেনকে বাসা থেকে তুলে এনে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাব্বির হোসেন, সাজ্জাদ শোয়াইব চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান, অর্থ সম্পাদক মো. তৌহিদুল ইসলাম এবং উপ-ছাত্রবৃত্তিবিষয়ক সম্পাদক আলরাজী সরকারের বিরুদ্ধে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের গাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। তিনি তাঁর বিভাগের কিছু শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে রাখেন বলে অভিযোগ। পরে নিরাপত্তা শাখার কাছে হস্তান্তর করে এবং ৭৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে তিন দিন পর অ্যাম্বুলেন্সটি ছেড়ে দেন।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের নামে যেসব অভিযোগ আসছে, সেগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এর দায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেবে না।
এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পারভীন জলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেভাবে লেগুনা–গাড়ি আটকে রেখেছেন, তা অত্যন্ত নিন্দনীয় আচরণ। এটা কারা করছেন, কেন করছেন, কীভাবে করছেন, তার উৎস খুঁজলে সহজেই জানা যাবে যে এর সঙ্গে ক্ষমতাশীল ছাত্রসংগঠনের শিক্ষার্থীরা জড়িত। তাঁরা জানেন যে তাঁদের অপরাধের বিচার হবে না। এর আগেও এসব শিক্ষার্থী অসংখ্য অপরাধ করে পার পেয়েছেন। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে।’
ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক আলিফ মাহমুদ বলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন, হুমকি, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ থাকলেও বিশ্ববিদ্যলয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এসব ঘটনায় শাস্তি না হওয়ায় আবাসিক হলগুলোয় ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যও কমছে না।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ভুক্তভোগীরা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করে না। দু–একটি ঘটনায় করলেও মীমাংসা করে অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়। ফলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। প্রক্টর বলেন, ‘আমাদের এই অনিয়মের সংস্কৃতি দূর করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এটি করতে হবে। আমরা তো জোর করে কিছু করতে পারি না।’