অবহেলায় অব্যবহৃত ভোলার গ্যাস

চাহিদা না থাকায় গ্যাস উৎপাদন করছে না বাপেক্স। প্রয়োজনীয় গ্যাস না পেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখছে পিডিবি। 

প্রতীকী ছবি

দক্ষিণের দ্বীপজেলা ভোলার গ্যাস নিয়ে আড়াই দশক পরও কার্যকর পরিকল্পনা নিতে পারেনি সরকার। এই গ্যাস জেলার বাইরে আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। জেলার ভেতরেও উৎপাদন সক্ষমতা অনুসারে গ্যাসের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। সরকারের অবহেলায় অব্যবহৃত থাকছে ভোলার গ্যাস।

বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ১৫ কোটি ঘনফুট উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও ব্যবহার হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস। চাহিদা না থাকায় গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে না এ গ্যাসক্ষেত্র থেকে। এ ছাড়া আবিষ্কারের পরও প্রায় চার বছর ধরে ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বর্তমানে দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। উৎপাদিত হয় ২৩০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি মেটাতে চড়া দামে সরকার ২০১৮ সাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির দিকে ঝুঁকলেও পড়ে আছে ভোলার গ্যাস। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু যথাযথ উদ্যোগের অভাবে ভোলার গ্যাস কাজে লাগছে না। এখন বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম নাগালের বাইরে যাওয়ার পর ভোলার গ্যাস নিয়ে কিছুটা চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।

ভোলায় মাটির নিচে গ্যাস ফেলে রেখে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির দিকে গেছে সরকার। এটা চরম অবহেলা ও অব্যবস্থাপনা এবং অদূরদর্শিতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
বদরূল ইমাম, ভূতত্ত্ববিদ

১৯৯৫ সালে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। একই সংস্থা ২০১৮ সালে আবিষ্কার করে ভোলার দ্বিতীয় গ্যাসক্ষেত্র ভোলা নর্থ। শাহবাজপুর থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয় ২০০৯ সালে।

আর ভোলা নর্থ থেকে এখনো উৎপাদন শুরু হয়নি। দুটি গ্যাসক্ষেত্র মিলে এখন দেড় ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসের মজুত থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পেট্রোবাংলা। নতুন কূপ খননের পর মজুত আরও বাড়তে পারে।

উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছে বাপেক্স

গ্যাস উৎপাদনের পর প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তা পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। বাপেক্স সূত্র বলছে, শুরু থেকেই ৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রক্রিয়াকরণের একটি ইউনিট কাজ করছে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রে। এরপর দুই কোটি ঘনফুটের একটি ইউনিট এনে অস্থায়ীভাবে বসানো হয়।

এখন আরও ৬ কোটি ঘনফুট প্রক্রিয়াকরণের একটি ইউনিট করা হয়েছে। কিন্তু এ উৎপাদন সক্ষমতা পড়ে থাকছে। চারটি কূপ থেকে গত মঙ্গলবার উৎপাদিত হয়েছে সাড়ে ৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস। আরও একটি কূপ খনন করার পর বসে আছে। গ্যাস নিতে পারছে না ভোক্তা পর্যায়ে এখানকার সরবরাহকারী সংস্থা সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার সক্ষমতা আছে। গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে আরও দুটি কূপ খননের কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস অনুসন্ধানে ভোলার চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

সুন্দরবন ও পিডিবির সমন্বয়হীনতা

সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি বলছে, ভোলায় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, দুটি ক্যাপটিভ (শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ), শিল্পকারখানা ও আড়াই হাজার বাসায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। সরকারি সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা দিনে সাড়ে তিন কোটি ঘনফুট। তবে পাইপলাইনে সমস্যা থাকায় গ্যাস দেওয়া হচ্ছে অর্ধেক।

এর ফলে তাদের একটি ইউনিট বন্ধ থাকছে। আর ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাড়ে তিন কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ৩৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও একটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র দিনে ৮০ থেকে ৯০ লাখ ঘনফুট গ্যাস নিচ্ছে। এর বাইরে শিল্প ও বাসাবাড়িতে দিনের চাহিদা ৪৫ লাখ ঘনফুট।

সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হয়। হঠাৎ করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো ইউনিট বন্ধ করা হলে গ্যাসের চাপজনিত সমস্যায় পাইপলাইন ফেটে যেতে পারে। এতে ঝুঁকি আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র সব সময় চালু রাখার নিশ্চয়তা চাইলেও তা দিতে পারেনি পিডিবি। সম্প্রতি গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে পিডিবিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে পিডিবির ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী গৌতম পাল প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস না পাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট বন্ধ রাখা হচ্ছে। আর সুন্দরবনের চিঠির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতামত জানতে চাওয়া হবে।

সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি বাইরে আনার

পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পরই নব্বইয়ের দশকে ভোলার গ্যাস জেলার বাইরে আনার প্রস্তাব দিয়েছিল বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিকল। ১২০ কিলোমিটার পাইপলাইন করার কথা বলেছিল তারা। এ গ্যাস ব্যবহার করে ভোলা, বরিশাল ও খুলনায় বিদ্যুৎকেন্দ্র করারও প্রস্তাব ছিল। কিন্তু এ প্রস্তাব নিয়ে এগোয়নি সরকার। এটি লাভজনক হবে না বলে ধারণা ছিল তৎকালীন সরকারের।

এখন বিশ্ববাজার থেকে এলএনজি আমদানি কমার পর ভোলার গ্যাস ব্যবহার নিয়ে নানা উপায় খুঁজছে সরকার। উৎপাদন বাড়াতে ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্রে দুটি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়েছে গাজপ্রমকে।

একটির খনন শুরু করেছে তারা। গ্যাস বাইরে আনার পাইপলাইন নির্মাণে নতুন করে মার্কিন কোম্পানি অ্যাকসিলারেট এনার্জির সঙ্গে আলোচনা করছে পেট্রোবাংলা। ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনায় যাবে এ পাইপলাইন। আরেকটি পাইপলাইন বরিশাল থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে পাইপলাইন নির্মাণের পথ ও খরচ নিয়ে প্রাথমিকভাবে পেট্রোবাংলার একটি কমিটি কাজ করছে। অ্যাকসিলারেটের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। গ্যাসের মজুত আরও বাড়লে জেলার বাইরে গ্যাস আনা লাভজনক হতে পারে।

তবে পাইপলাইন নির্মাণের দায়িত্বে থাকা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) সূত্র বলছে, ভোলার গ্যাস বাইরে আনা নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তারা নিজেরাও বিশ্লেষণ করে দেখছে।

ভোলায় মাটির নিচে গ্যাস ফেলে রেখে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির দিকে সরকার গেছে বলে মনে করেন ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে নানা অজুহাত দেখানো হচ্ছে। আর উৎসাহ হচ্ছে এলএনজি আমদানির দিকে। এটা চরম অবহেলা ও অব্যবস্থাপনা এবং অদূরদর্শিতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। ভোলার গ্যাস ব্যবহার করতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’