বাসায় খেতে না পেয়ে অসুস্থ হওয়া মা ও যমজ শিশুর দায়িত্ব নিলেন স্বজনেরা

উত্তরার বাসা থেকে উদ্ধার করার পর ওই মাকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার উত্তরার একটি বাসা থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার যমজ মেয়েশিশু ও তাদের মায়ের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বজনেরা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যমজ শিশুর মায়ের দুই ভাই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে তাঁদের দায়িত্ব বুঝে নেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর দেখে উদ্ধারের দুই দিন পর বোন ও তাঁর দুই শিশু কন্যার দায়িত্ব নেন তাঁরা।

গত শনিবার গভীর রাতে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের একটি বাড়ির ফ্ল্যাট থেকে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় পুলিশ দুই যমজ কন্যাশিশু ও তাদের মাকে উদ্ধার করে। পুলিশের ভাষ্য, খাবারের অভাবে দুই সন্তানকে নিয়ে এই নারী ফ্ল্যাটে তিন দিন ধরে অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন। ঘরে কোনো খাবার ছিল না। একটি কৌটায় শুধু লবণ ছিল। ওই বাসায় এক মাস ধরে কোনো রান্না হয়নি বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকারী দলের এক পুলিশ সদস্য। বাসায় প্রয়োজনীয় জামাকাপড়ও ছিল না। এই নারী এখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। তাঁর দুই মেয়েশিশু জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি।

পুলিশের উত্তরা পূর্ব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুজাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যমজ মেয়েশিশু ও তাদের মাকে উদ্ধারের পর উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরে ওই নারীর কয়েকজন স্বজন এসে তাঁদের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান। সেখানে ওই নারীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ওই নারী ও তাঁর দুই সন্তানকে উদ্ধারের পর তাদের ‘পারি ফাউন্ডেশন’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা হাসপাতালে দেখভাল করছেন। তাঁদের একজন সংগঠনের সহসম্পাদক ওয়াসিম খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই নারীর দুই ভাই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এসে ওই নারী ও তাঁর দুই সন্তানকে তাঁদের জিম্মায় নিয়েছেন। তাঁদের বোনের চিকিৎসা এবং সার্বিক দেখভাল তাঁরাই করবেন বলে জানিয়েছেন। গত দুই দিনে অনেক স্বজন ওই নারী ও তাঁর দুই সন্তানের খোঁজ নিতে এসেছেন।

স্বজন ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যমজ মেয়েশিশুর মা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগে ভুগছেন। এই সমস্যা থেকেই নিজেকে এবং দুই শিশুসন্তানকে স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। দীর্ঘ সময় ধরে না খেয়ে থাকতে থাকতে শারীরিক অবস্থাও ভালো নেই তাঁর। দুই শিশু কন্যার শারীরিক অবস্থা এখন স্বাভাবিক হলেও মানসিক অবস্থা ভালো নয়। মা ও দুই মেয়ের চিকিৎসার পাশাপাশি স্বজনদের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দরকার।

যমজ শিশুর মায়ের এক ভাই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বোনের মানসিক সমস্যা আছে, এটা তারা জানতেন। তবে তাঁর মানসিক অবস্থা এতটা খারাপ হয়েছে সেটি জানতেন না। বোনের খোঁজ রাখতেন ছোট ভাই। কানাডাপ্রবাসী বড় ভাই প্রতি মাসে টাকাও পাঠাতেন। ছোট ভাই কেন খোঁজ রাখেননি, আর কেনই–বা বড় ভাইয়ের পাঠানো টাকা বোনের কাছে পৌঁছাত না, সেটি তিনি বলতে পারছেন না। ভাইয়ের ভাষ্য, সর্বশেষ বোনের সঙ্গে এক বছর আগে তাঁর দেখা হয়েছিল। বোন এমন অবস্থায় আছে, সেটা তিনি ভাবতেও পারেননি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, ওই নারী ও তাঁর দুই সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য কেমন আছে, সেটি জানার জন্য পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে সেটি এখনো বলার মতো অবস্থায় আসেনি। পর্যবেক্ষণের পর তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পরে করণীয় কী হবে, সেটি নির্ধারণ করা হবে।

দূরত্ব ছিল ভাইদের সঙ্গে

যমজ দুই শিশুর মায়ের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছর আগে ওই নারীর বিয়ে হয়। অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থাতেই স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। কিছুদিন পরই তাঁর দুই কন্যাশিশু জন্ম নেয়। দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি বাবার কাছেই থাকতেন। বাবা ছিলেন আইনজীবী। ২০১৮ সালে তিনি মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পরই ওই নারী আর্থিক সংকটে পড়েন। তাঁর দুই শিশুসন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তিনি অনেকটা ঘরে আবদ্ধ হয়ে পড়েন।

ওই নারীর এক চাচাতো বোন প্রথম আলোকে বলেন, বাবা মারা যাওয়ার আগে উত্তরার ওই ফ্ল্যাটটি ওই নারীর নামে লিখে দেন। তবে বাবা মারা যাওয়ার পরই সমস্যা শুরু হয়। ভাইদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। উত্তরার ওই বাড়িতে ওই নারীর ভাইদের আরও তিনটি ফ্ল্যাট আছে। তাঁরা এখন সেখানে থাকেন না। সর্বশেষ গত আগস্টে এক ভাই ওই বাড়ি ছেড়েছেন। ওই ভাই তাঁদের মাকে সঙ্গে নিয়ে যান। তারপর আর ওই নারীর খোঁজ কোনো ভাই বা স্বজনেরা নেননি।

চাচাতো বোনের ভাষ্য, তিনিও উত্তরায় থাকেন। তিনি বিভিন্ন সময় ওই নারীর বাসায় খাবার নিয়ে যেতেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টার দিকে তিনি ওই ফ্ল্যাটে যান। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে দরজা ধাক্কালেও ভেতর থেকে কেউ দরজা খোলেননি। ওই নারী প্রায়ই এমন করতেন বলে চাচাতো বোন মনে করেছিলেন, ইচ্ছা করেই দরজা খোলেননি। তবে রোববার সকালে পুলিশের ফোন পেয়ে  তিনি জানতে পারেন তাঁর চাচাতো বোন ও তাঁর সন্তানদের অবস্থা ভালো না।

স্বজনেরা জানান, ওই নারীর চার ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই কানাডাপ্রবাসী, এক ভাই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, এক ভাই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং এক ভাই বিসিএস কর্মকর্তা। তাঁদের নিকটাত্মীয়দের অনেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।