‘আমরা হোঁচট খাই, কিন্তু ভেঙে পড়ি না’
রওনক জাহান (উষা) ছোটবেলা থেকেই ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। তবে তাঁর জীবন এখন হুইলচেয়ারে বন্দী।
২০১১ সালের ৩ অক্টোবর বিকেলে রাজধানীর একটি ভাড়া বাসার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান রওনক। জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালে। বুঝতে পারেন, তাঁর কোমর থেকে পা পর্যন্ত কোনো অনুভূতি নেই। তারপর থেকেই তাঁর জীবন পাল্টে যেতে থাকে।
পাল্টে যাওয়া জীবনে ২০২১ সালের শেষ দিকে রওনকের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় রবিউল ইসলাম (অপু) নামের এক যুবকের। তিনিও হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন। পরে তাঁরা বিয়ে করেন।
ময়মনসিংহের শেরপুরের ছেলে রবিউল। ২০১৪ সালে তিনি ঢাকায় ঘুরতে এসেছিলেন। তাঁর চাচাতো ভাই ট্রাক চালাতেন। ওই ট্রাকে ঘুরতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় রবিউলের ঘাড়সহ স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকায় এক হাসপাতালে তাঁর প্রায় সাত মাস চিকিৎসা চলে। চিকিৎসা শেষে হুইলচেয়ারকে সঙ্গী করে তিনি বাড়ি ফেরেন। তখন থেকে তিনি দুই হাত দিয়ে প্রায় কিছুই করতে পারেন না। প্রায় সব কাজেই অন্যের সহযোগিতা লাগে।
মুঠোফোনে রওনক বলেন, ‘ফেসবুকে পরিচয়ের পর আমরা একে অন্যকে জানতে থাকি। বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা, তারপর বিয়ে করার কথা ভাবি। কিন্তু দুই পরিবার থেকে প্রবল আপত্তি আসে। আপত্তির কারণ—দুজনই হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী। তাঁদের বিয়ে অসম্ভব।’
রওনক আরও বলেন, ‘তবে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে আমরা আমাদের সমস্যা যতটা বুঝতে পারব, অন্যরা ততটা পারবে না। ভালোবাসা তো ছিলই। আমাদের বিশ্বাস ছিল, বিয়ে করে আমরা ভালো থাকব। এখন আমরা ভালো আছি। শ্বশুর-শাশুড়ি আর আমরা দুজন—এই নিয়ে আমাদের সুখের সংসার।’
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও ভালো থাকা যায়
রওনক-রবিউল দম্পতির বিয়ের বয়স দেড় বছর। রওনক বলেন, সম্পর্কে ভালোবাসা, বিশ্বাস ও পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও দুজন মানুষ ভালো থাকতে পারেন।
রওনক বললেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গেলে তাঁকে দেখার জন্য বাড়িতে ভিড় লেগে থাকত। মানুষের কত যে প্রশ্ন ছিল। এমন দুজন কীভাবে সংসার করবে, তা ভেবে মানুষ অবাক হতো। এখনো অনেকে দেখতে আসেন। তাঁরা যখন দেখেন, চেয়ার সামনে রেখে বিশেষ কায়দায় তিনি সবজি কাটছেন, স্বামীকে হুইলচেয়ার বা ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার মোটরবাইকে ওঠা-নামার সময় সাহায্য করছেন, তখন মানুষ অবাক হন।
রওনক আরও বলেন, ‘আমি হুইলচেয়ারে চলাফেরা করি। আর আমার স্বামী যদি সুস্থ-স্বাভাবিক হতেন, তাহলে শ্বশুরবাড়িতে নিশ্চয়ই আমাকে নানা কথা শুনতে হতো। তখন আমি স্বস্তিতে থাকতাম না। তবে এখন আমার শ্বশুরবাড়িতে হুইলচেয়ার নিয়ে কোনো বাজে কথা শুনতে হয় না। কেননা, তাঁদের ছেলেও তো আমার মতোই একজন।’
রওনকের ভাই-বোনেরা বিয়েতে রাজি ছিলেন না। তবে স্বামীর পরিবার থেকে তেমন বাধা আসেনি। ঝিনাইদহের মেয়ে রওনক বর্তমানে শেরপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।
দুর্ঘটনার আগে রওনক রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। আজিমপুরের এক কলোনিতে বাসাভাড়া নিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই তিন মাস ক্লাস করেন। তারপর দুর্ঘটনায় পড়ে তাঁর আর ক্লাস করা হয়নি। বিভিন্ন পরীক্ষা দিয়েছেন কলেজের নিচতলায়। আর চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় যে কলেজে আসন পড়ত, সেখানে আবেদন করে নিচতলায় আসন ফেলার ব্যবস্থা করতেন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে তিনি অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
রওনক জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কল সেন্টারে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে এক বছর কাজ করেছেন। প্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে কাজ করা উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনেও কাজ করেছেন। তিনি সম্প্রতি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়েছেন। আপাতত একটি চাকরির অপেক্ষায় আছেন তিনি।
রওনক জানালেন, ২০১৭ সালে তিনি অনলাইনে কবুতর বিক্রির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বিয়ের পর রবিউল এই ব্যবসা দেখতেন। বেশ ভালোই চলছিল। তবে করোনার সময় ব্যবসাটা আর চলেনি। আপাতত অনলাইনে নতুন ব্যবসার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
রবিউল এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। দুর্ঘটনার পর তাঁর আর পড়া হয়নি।
চাকরি ও ব্যবসা নেই। তাহলে দুজনের খরচ চলছে কী করে, জানতে চাইলে রওনক বলেন, তাঁর শ্বশুর অটোরিকশা চালান। মূলত এ দিয়েই চলছে চারজনের সংসার। তাই যে করেই হোক একটি চাকরি খুঁজছেন রওনক। রবিউল তিন মাস পরপর সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন ২ হাজার ৫০০ টাকার মতো করে।
রওনকের বাবা মো. আবদুল গনি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান। তিনি ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা শামছুন্নাহার মারা গেছেন গত বছর। পরিবারের ছোট মেয়ে হিসেবে সবার আদরে বড় হয়েছেন রওনক। ঝিনাইদহের সালেহা বেগম মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর রওনক পড়াশোনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। দুর্ঘটনার পর সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনকেন্দ্রে (সিআরপি) চিকিৎসা নেন তিনি।
আরেক দুর্ঘটনা
রওনক জানালেন, ২০১১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাঁর মেজ বোন ছাদ থেকে পড়ে স্পাইনাল কর্ডে ব্যথা পান। তাঁর পুরো শরীর অবশ হয়ে যায়। তাঁকে সিআরপিতে ভর্তি করা হয়। তখন তিনি ও তাঁর মা ভাগাভাগি করে সিআরপিতে থাকতেন। অক্টোবরে ঘটে তাঁর জীবনে দুর্ঘটনা।
রওনক আরও বলেন, একপর্যায়ে সিআরপিতে তাঁরা দুই বোন পাশাপাশি বিছানায় থাকতেন। মা তাঁদের সেবা করতেন। একজন মা কেবল বলতে পারবেন, তাঁর জন্য এমন মুহূর্ত কতটা কষ্টের, কতটা মর্মান্তিক, কতটা বেদনাদায়ক। ২০১২ সালে তাঁর বোন মারা যান।
চিকিৎসা শেষে সিআরপির মাধ্যমে রওনক ইডেন মহিলা কলেজের হোস্টেলে ওঠেন।
আরও ভালো থাকার জন্য দরকার চাকরি-ব্যবসা
মুঠোফোনে কথা হলো রবিউলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা ভালো আছি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
নিজে হুইলচেয়ার ব্যবহার না করলে রওনককে বিয়ে করতেন কি না, জানতে চাইলে রবিউল বলেন, ‘এটা কঠিন প্রশ্ন। সেভাবে চিন্তা করেননি।’
হাসতে হাসতে রবিউল বলেন, রওনকের হাসি দেখার পর তিনি হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন বলে পিছিয়ে আসার আর সুযোগ ছিল না বলেই তাঁর মনে হয়।
রওনক ও রবিউল দুজনই জানালেন, এখন তাঁরা ভালো আছেন। তবে নিজেরাই যখন নিজেদের খরচ চালাতে পারবেন, মা–বাবার দেখাশোনা করতে পারবেন, তখন আরও ভালো থাকা সম্ভব হবে। সে জন্য দরকার চাকরি বা ব্যবসা করা।
রওনক বলেন, জেলা শহরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রবেশগম্যতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ঘুরে ঘুরে চাকরির খোঁজ করা বেশ কষ্টকর। তবে কখনো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারলে এই দম্পতি অন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছার কথা জানান।
রওনক ফেসবুকে স্বামী-স্ত্রীর একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘আমরা হোঁচট খাই, কিন্তু ভেঙে পড়ি না। কারণ, স্বপ্নবাজেরা গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে থামে না।’