স্থাপত্যের মগ্ন কবি সামসুল ওয়ারেস

সামসুল ওয়ারেসছবি: তানভীর আহাম্মেদ

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনের স্থাপত্য সারা পৃথিবীতে নন্দিত। আমেরিকান স্থপতি লুই আই কান (১৯০১-১৯৭৪) এর নকশা করেন। তাঁর ছেলে নাথানিয়েল কান বাবার ওপরে একটা চমৎকার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, নাম মাই আর্কিটেক্ট। প্রামাণ্য এই ছবি অস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল।

নাথানিয়েল খুব ছোটবেলায় একবার বাবাকে দেখেছিলেন। বাবা এসেছিলেন তাঁদের গাছপালা ঢাকা সুন্দর বাড়িতে। নাথানিয়েলের সঙ্গে কিছুক্ষণ মজার সময় কাটিয়েছিলেন। তার ভিডিও আছে। এরপর বাবা আর আসেননি। মা অপেক্ষা করতেন, লুই কান আসবেন। নাথানিয়েলের বয়স যখন ১২ বছর, তখন বাবা মারা যান।

বড় হয়ে নাথানিয়েল জানতে পারলেন, তাঁর বাবা অনেক বড় আর্কিটেক্ট ছিলেন। আসলে বাবা কে? এই অন্বেষায় ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়লেন নাথানিয়েল। পৃথিবীর যত জায়গায় লুই কানের স্থাপত্যকীর্তি আছে, সেসবের মাহাত্ম্য বোঝার চেষ্টা করলেন।

সবশেষে নাথানিয়েল এলেন বাংলাদেশে। বুড়িগঙ্গার জলস্রোত, তারপর শেরেবাংলা নগরের লেকের ঢেউ। তার মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন। কী মহিমাপূর্ণ এক স্থাপনা। ভোরবেলা সংসদ ভবনের সামনে জগিং করা মানুষজনকে জিজ্ঞেস করলেন, এই ভবনের আর্কিটেক্টের নাম কী! একজন ব্যায়াম করতে করতে বললেন, ফারা খান।

প্রথম আলোর ভিডিও সাক্ষাৎকার সিরিজ ‘ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো’র এবারের অতিথি সামসুল ওয়ারেস। স্থপতি, শিল্পসমালোচক, স্থাপত্যের অধ্যাপক, স্থাপত্যভাবুক। আমার কাছে তাঁকে মনে হয়, স্থাপত্যের মগ্ন তাপস।

তারপর ক্যামেরার সামনে এলেন একজন। বাংলাদেশের স্থপতি, বুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগের অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস।

নাথানিয়েল কান বলছিলেন, তিনি এই ভবনের দৃশ্য ধারণ করবেন ১০ মিনিটে। সামসুল ওয়ারেস বললেন, বৃথা শ্রম। কোনো মানে হয় না। এই ভবন ধারণ করবে মাত্র ১০ মিনিটে? তুমি জানো, এই ভবন কী? এটা আমাদের গণতন্ত্রের প্রতীক। তিনি আমাদের ভালোবাসা দিয়ে গেছেন। এত বড় মানুষ, সবাইকে ভালোবাসা দিয়েছেন, সে জন্য হয়তো তিনি তাঁর সন্তানকে ভালোবাসা দিতে পারেননি। বলতে বলতে সামসুল ওয়ারেসের চোখ ভিজে আসে। নাথানিয়েল কান ছবিটা শেষ করেন এইভাবে, ‘আমি আমার বাবাকে খুঁজে পেয়েছি।’

আমি এই সিনেমা দেখেছি নাথানিয়েল কানের সঙ্গে একই ছাদের নিচে, ঢাকায় স্টার সিনেপ্লেক্সে এর আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনীতে। আমার মনে আছে, দর্শকেরা সবাই চোখ মুছছিলেন।

প্রথম আলোর ভিডিও সাক্ষাৎকার সিরিজ ‘ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলো’র এবারের অতিথি সামসুল ওয়ারেস। স্থপতি, শিল্পসমালোচক, স্থাপত্যের অধ্যাপক, স্থাপত্যভাবুক। আমার কাছে তাঁকে মনে হয়, স্থাপত্যের মগ্ন তাপস।

সামসুল ওয়ারেস, ১৯৪৬ সালে ২১ জানুয়ারি জন্ম তাঁর ঢাকার বংশালে। ছেলেবেলা কেটেছে প্রধানত চাঁদপুরে, ওখানেই স্কুল। এরপর ঢাকা কলেজ, সেখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে ক্লাস শুরু করেন।

কাজ করেছেন স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। প্রথম দিনের কাজ করার স্মৃতি বড়ই মজার। সামসুল ওয়ারেস বলেন, ‘মাজহারুল ইসলামের সুন্দর একটা কলোনিয়াল বিল্ডিং ছিল তখন, ৩ নম্বর পরীবাগে। ওখানে সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, কখন উনি ডাকবেন। হঠাৎ উনি এলেন। বললেন, কী ব্যাপার, কী চাই। বললাম, আমরা এবার পাস করেছি আর্কিটেকচারে। আপনার অফিসে কাজ করতে চাই। উনি বললেন, ভালো কথা, আসেন। আমাদের তিনজনকে তিনটি টেবিল দিলেন। এরপর বললেন যে কাজ শুরু করেন। আমি বললাম, স্যার, আমরা ঠিক আজকেই প্রস্তুত হয়ে আসিনি। কাল ঠিক ৯টায় আসি। আজ ১১টা হয়ে গেছে। উনি বললেন, না না না, কালকে থেকে না, এখন। এখনই বসে যান। চাকরি শুরু হয়ে গেল। উনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন না কিছু, কী করলাম, রেজাল্ট কী।’

এফ আর খান ঢাকা শহরের একটা প্ল্যান দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন সামসুল ওয়ারেসদের, তাঁরা আবার তা জমা দিয়ে এসেছিলেন রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে। রাজউকের ওই সময়ের চেয়ারম্যান সেটা হারিয়ে ফেলেন। কী অপূরণীয় ক্ষতি!০

ভুবনবিখ্যাত প্রকৌশলী এফ আর খানের সঙ্গেও সামসুল ওয়ারেসের পরিচয় ছিল। তাঁকে ঢাকায় এনে সেমিনার করেছিলেন। এফ আর খান সম্পর্কে সামসুল ওয়ারেসের স্মৃতি—‘রবীন্দ্রসংগীত আমার সামনেও গেয়েছেন। মুড়ি আর শিঙাড়া খেয়ে খুব খুশি হলেন। সুন্দর অ্যাডজাস্ট করতে পারতেন।’

এফ আর খান ঢাকা শহরের একটা প্ল্যান দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন সামসুল ওয়ারেসদের, তাঁরা আবার তা জমা দিয়ে এসেছিলেন রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে। রাজউকের ওই সময়ের চেয়ারম্যান সেটা হারিয়ে ফেলেন। কী অপূরণীয় ক্ষতি!

সামসুল ওয়ারেস স্যারের কথা শুনে মনে হলো কবিতা শুনছি, সংগীত আস্বাদন করছি এবং শেষতক স্পিরিচুয়ালিটির দিকে যাচ্ছি। এত ইতিবাচক কথোপকথন, প্রেরণা আর উদ্যমসঞ্চারী এবং কিছুটা ধ্যানের মতো—আমার মনে এর রেশ রয়ে যাবে অনেক দিন।

লুই আই কান সম্পর্কে সামসুল ওয়ারেসের বিস্ময়ভরা শ্রদ্ধা সব সময়ই ক্রিয়াশীল। তিনি বলেন, ‘তাঁর আর্কিটেকচারটা অন্য লেভেলের, একটা স্পিরিচুয়াল কনটেন্টে কাজ করেছেন। অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ের ভেতরে লাইটের যে খেলা আছে, তার যে হিউজনেস আছে, সেখানে আপনাকে একেবারেই ছোট্ট করে ফেলে। আপনি যখন একদম ছোট হয়ে যান, দেন ইউ স্টার্ট রিয়ালাইজিং গ্রেটার আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড। যেমন ধরেন আপনি সমুদ্রের পাড়ে গেলেন, হিমালয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে যেটা হয় আরকি। আমার মনে হয় যে উনার ওই অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং ওই কোয়ালিটির একটা।’

সামসুল ওয়ারেস স্যারের কথা শুনে মনে হলো কবিতা শুনছি, সংগীত আস্বাদন করছি এবং শেষতক স্পিরিচুয়ালিটির দিকে যাচ্ছি।

এত ইতিবাচক কথোপকথন, প্রেরণা আর উদ্যমসঞ্চারী এবং কিছুটা ধ্যানের মতো—আমার মনে এর রেশ রয়ে যাবে অনেক দিন।

আমি আমার স্থপতি সহপাঠীদের ঈর্ষা করি, যাঁরা তাঁর ক্লাস পেয়েছেন।