অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি হয় না, থামছে না বিতর্কিত ঘটনা

অপরাধ করে কেউ কেউ লঘুদণ্ডে পার পেয়ে যান। কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, কেউবা অসদাচরণ করছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বন্ধ হচ্ছে না। সম্প্রতি পরপর কয়েকটি ঘটনার পর নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়েছে জনপ্রশাসন। বিশেষ করে মাঠপ্রশাসনের কয়েকজন নবীন কর্মকর্তার আচরণে অনেকেই ক্ষুব্ধ। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ অপেশাদার আচরণ করছেন। কারও কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও উঠছে।

অভিযোগ রয়েছে, অপরাধ অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না; বরং কেউ কেউ ‘লঘুদণ্ড’ পেয়ে পার পেয়ে যান। ফলে এমন অপেশাদার আচরণের ঘটনা থামছে না।

লালমনিরহাট সদর উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে পাঁচ সাংবাদিককে আটকে রেখে হুমকি, শেরপুরের নকলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক সাংবাদিককে কারাদণ্ড, চট্টগ্রামে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তর্কে জড়ান একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

প্রশাসনে এমন ঘটনা কেন বারবার ঘটছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এতে কর্মকর্তারা শিক্ষা পাবেন।
মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

কর্মকর্তাদের এমন আচরণ কেন—সেই প্রশ্নে প্রশাসনের মধ্যে নানা কথা উঠে এসেছে। একটি বড় আলোচনা হলো, অনেক কর্মকর্তা সরকারি চাকরির রীতিনীতি উপেক্ষা করে রাজনৈতিক আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করেন। এই প্রক্রিয়ায় অনেকে যথাযথ যোগ্য ও দক্ষ না হয়েও কখনো কখনো প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যাচ্ছেন। আবার পুরোপুরি আইনকানুন না জানা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে মাঠ প্রশাসনের কিছু কিছু নবীন কর্মকর্তা ভ্রাম্যমাণ আদালত চালাতে গিয়েও বিপত্তি বাধিয়ে ফেলছেন। অনেকে আবার মূল দায়িত্বের কথাও ভুলে গিয়ে অসদাচরণ করছেন।

অবশ্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার মধ্যে অপেশাদার আচরণকারীর সংখ্যা খুবই কম। তবে কেউ যাতে অসদাচরণ না করেন, সেই ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

বিতর্কিত কিছু ঘটনা

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমাম আল রাজী টুলুর বিরুদ্ধে ২০ মার্চ রাশেদা খানম নামের বৃদ্ধ এক নারীকে নিজ কার্যালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখার অভিযোগ ওঠে। উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় রাশেদার ছেলেকে আটক করতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে রাশেদাকে আটক করে আনা হয়।

পরে জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম জানিয়েছিলেন, অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে গিয়ে ইউএনওর গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। হামলার পেছনে ওই নারীর ইন্ধন ছিল। তাই তাঁকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু মানবিক কারণে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

১৪ মার্চ খবর সংগ্রহ করতে গেলে পাঁচ সাংবাদিককে নিজ কার্যালয়ে আটকে রেখে হুমকি দেন লালমনিরহাট সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ-আল-নোমান। পরে খবর পেয়ে ওই জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) টি এম এ মমিন সেখানে গিয়ে সাংবাদিকদের মুক্ত করেন। অবশ্য তার পরদিন আবদুল্লাহ নোমানকে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলায় বদলি করা হয়।

৮ মার্চ শেরপুরের নকলায় ইউএনও কার্যালয়ে তথ্য চাইতে গেলে স্থানীয় এক সাংবাদিককে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসদাচরণের অভিযোগে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। অভিযোগ ওঠে, তথ্য চাওয়ায় ওই সাংবাদিকের ওপর ক্ষুব্ধ হন ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন। এ ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা হয়। তথ্য কমিশন ঘটনার তদন্তে নামে। পরে অবশ্য ওই সাংবাদিক জামিনে মুক্তি পান।

১২ মার্চ চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেখানকার একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তর্কে জড়ান। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই ব্যবসায়ীর কাগজপত্র দেখতে চান। তখন ব্যবসায়ী বলেন, ‘হোল্ড অন’। শব্দটি ভালোভাবে নেননি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এই ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়।

এর আগে ২০২১ সালে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার তৎকালীন ইউএনও সীমা শারমীন ‘ছাগলে ফুল খাওয়ার অপরাধে’ মালিককে দুই হাজার টাকা জরিমানা করে সমালোচিত হন। একই বছর কুমিল্লার বুড়িচংয়ের এক ইউএনওকে ‘আপা’ সম্বোধন করায় খেপে গিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার তৎকালীন এক ইউএনও ফুটবল খেলার ট্রফি ভেঙে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন।

সম্প্রতি সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তোলেন সাবেক সংসদ সদস্য এইচ এম গোলাম রেজা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে তিনি লিখিত অভিযোগ দেন। তাঁর অভিযোগ, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহযোগিতা করবেন এমন আশ্বাস দিয়ে দেড় কোটি টাকা নেন ডিসি। পরে সহযোগিতা করেননি। টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল শনিবার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, তিনি (সাবেক সংসদ সদস্য) কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন। কর্তৃপক্ষ এখন অভিযোগ তদন্ত করে দেখবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, সরকারি কর্মকর্তারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কী শাস্তি হবে, সেটি আচরণবিধিতে স্পষ্ট করে বলা আছে। আবার সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রের (পিএটিসি) মাধ্যমে বনিয়াদি প্রশিক্ষণ এবং রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত বিসিএস প্রশাসন একাডেমির মাধ্যমে আইনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া অনেক কর্মকর্তা দেশে-বিদেশে আরও বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণ পান। প্রায় সব প্রশিক্ষণেই কর্মকর্তাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তাঁরা জনগণের সেবক। তবুও অনেক কর্মকর্তা অসদাচরণ করছেন।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কর্মকর্তাদের আচরণগত উৎকর্ষের জন্য নানা স্তরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশাসনে অসদাচরণের ঘটনা খুব বেশি নয়। তবু যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হয়।

লঘুদণ্ডে পার

প্রশাসনের কোনো কোনো কর্মকর্তা অপরাধ করলেও সরকারি আচরণবিধি অনুযায়ী যে শাস্তি পাওয়ার কথা তা পান না বলে অভিযোগ আছে। তার বদলে লঘুদণ্ড পান। যেমন স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং একাধিক নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত বছর একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবকে বেতন কমিয়ে ‘লঘুদণ্ড’ দেওয়া হয়।

‘পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ’ ও ‘অসদাচরণের’ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত বছর পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়জুন্নেছা আক্তারকে ‘বেতন গ্রেডের নিম্নতম ধাপে অবনমিতকরণ’ করে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। ছয় মাস না যেতে ‘নবীন কর্মকর্তা’ বিবেচনায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমা (অব্যাহতি) পেয়েছেন তিনি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা প্রথম আলোকে বলেন, কোনো প্রশিক্ষণেই কর্মকর্তাদের রূঢ় হতে বলে না। তাঁদের বলা হয় জনগণের সেবক। তবু এসব ঘটনা দেখলে তিনি বিস্মিত হন। প্রশাসনে এমন ঘটনা কেন বারবার ঘটছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এতে কর্মকর্তারা শিক্ষা পাবেন।