সামাজিক বনায়নে বাসস্থান হারানোর ভয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী

সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলে বন বিভাগের সঙ্গে তাঁদের ভূমির বিরোধ বাড়ছে।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ডলুছড়া পুঞ্জিতে গত বছরের ২৭ আগস্ট বন বিভাগ সামাজিক বনায়নের জন্য গাছ লাগাতে যায়। ওই জায়গা নিয়ে খাসিদের সঙ্গে বন বিভাগের মামলা চলছে। তাই সামাজিক বনায়নে খাসিরা বাধা দেন। এ সময় তাঁদের ওপর বন বিভাগের মুরইছড়া বিট অফিসের লোকজন ও তাঁদের সহযোগীরা হামলা চালান বলে অভিযোগ ওঠে। পরে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সালিস বৈঠকে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এক বছর পেরিয়ে গেলেও খাসিদের শঙ্কা কাটেনি।

মুরইছড়া পুঞ্জির নারীমন্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) ফ্লোরা বাবলি তালাং বলেন, ‘সামাজিক বনায়ন, ইকোপার্ক কিংবা চা–বাগানের সম্প্রসারণ—এ রকম নানা নতুন অজুহাত সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা বাসস্থান হারানোর ভয়ে আছি। দুঃখের কথা, সরকারিভাবে এসব তৎপরতা চলছে।’

বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের সভাপতি পিডিশন–প্রধান সুচিয়াং বলেন, বৃহত্তর সিলেটে ৯২টি খাসিপুঞ্জি আছে। এর মধ্যে অন্তত ২০টি পুঞ্জিতে জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ চলছে।

শুধু বৃহত্তর সিলেট নয়, দেশের সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী–অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমির বিরোধ বাড়ছে। এরই মধ্যে আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘প্রথাগত জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিস্তারে/ ছড়িয়ে দিতে আদিবাসী নারীর ভূমিকা।’

সদ্য প্রকাশিত জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মোট ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ৫০টি এবং মানুষের সংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১২টি জাতিগোষ্ঠী ও বাকিরা সমতলে বসবাস করে। সমতলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা ৬ লাখ ৬০ হাজারের বেশি। পাহাড় ও সমতল—দুই জায়গাতেই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের বেশির ভাগ মানুষের বসবাস বনসংলগ্ন এলাকায়। তাঁদের জীবনের সঙ্গে বনের সম্পর্ক নিবিড়।

বৃহত্তর সিলেটে পাঁচ–ছয় বছর ধরে খাসি ও গারোদের সঙ্গে বন বিভাগের জমির বিরোধ বাড়ছে। জানতে চাইলে বন বিভাগের মৌলভীবাজারের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জি এম আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘খাসিরা বন বিভাগের জায়গা দখল করে রাখছেন। আমাদের জমিতে আমরা সামাজিক বনায়ন করতে গেলে তাঁরা বাধা দিচ্ছেন।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাসিরা মূলত পান চাষের ওপর নির্ভরশীল। পুঞ্জিসংলগ্ন বনেই পান চাষ করা হয়। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে তাঁরা বন সংরক্ষণ করেন। আর সামাজিক বনায়ন হলো কৃত্রিম বনায়ন। নির্দিষ্ট মেয়াদের পর তা কেটে ফেলা হয়। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে একাধিক বহুজাতিক সংস্থার অর্থায়নে বন বিভাগ দেশের বিভিন্ন স্থানে সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের আওতায় অ্যাকাশিয়া, ইউক্যালিপটাসগাছ লাগিয়ে সামাজিক বনায়ন করছে।

প্রায় চার দশক ধরে মধুপুর বনে কাজ করা প্রকৃতিবিদ ফিলিপ গাইন মনে করেন, দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বন মধুপুরের বিস্তৃত এলাকায় সামাজিক বনায়ন শুধু ব্যর্থ হয়নি, সেই বন উজাড়ে এই প্রকল্পের ভূমিকা আছে।

স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ, সামাজিক বনায়ন করতে গিয়ে বন বিভাগ নিজেদের তৈরি শর্তও লঙ্ঘন করছে। কারণ, সামাজিক বনায়নের শর্ত হচ্ছে, এটি হবে ক্ষয়িত ও বিরান ভূমিতে। কিন্তু খাসি অঞ্চলে প্রাকৃতিক বনে সামাজিক বনায়ন করছে বন বিভাগ। আবার উপকারভোগী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিতে হয়। সেই শর্তও মানা হয় না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সামাজিক বনায়ন বন বিভাগের লাভের বিষয়। উপকারভোগী নির্বাচনে টাকা আসে, আবার এসব প্রকল্প বাস্তবায়নেও টাকা আছে। যে গাছ লাগিয়ে আবার কেটে ফেলা হয়, সেখানে তো প্রকৃতি সংরক্ষণের কিছু থাকে না।

জানা গেছে, মধুপুর বনে একটি কৃত্রিম লেক (হ্রদ) করার উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। বনে লেক করে পর্যটন কেন্দ্র করা হবে। এতে অন্তত ১৪টি গারো পরিবারের আবাদি জমি নষ্ট হবে। বনের ৯ হাজার ৫৪১ একর জমিকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে ১৩টি গারো গ্রাম পড়েছে। হ্রদ প্রকল্প এলাকায় গারোদের যেতে দেওয়া হয় না।
মধুপুরের জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, ‘বন বিভাগ আমাদের উচ্ছেদ করেনি। কিন্তু প্রতিমুহূর্তে আমরা উচ্ছেদের আতঙ্কে থাকি।’

বন বিভাগের সঙ্গে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভূমির বিরোধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, খাসি অঞ্চলে তাদের সম্মতি নিয়েই সামাজিক বনায়ন করা হবে। স্থানীয় মানুষ মত না দিলে মুধপুরে কৃত্রিম হ্রদ প্রকল্প বাতিল করা হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ভূমির বিরোধ প্রবল। তবে সেখানকার বিরোধ নিরসনে একটি আইন হয়েছে। আবার আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে। কিন্তু সমতলে এমন আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সুযোগই নেই। এর ফলে অনেকে ভূমিহীন হচ্ছেন, কেউ কেউ দেশান্তরি হচ্ছেন।

পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৯৮৪ সালে ২৩৭টি রাখাইন গ্রাম ছিল, এখন আছে ৪৪টি।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথিন প্রমিলা বলেন, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারি নানা প্রকল্পের কারণে রাখাইনরা জমি হারিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের জমির দখল আছে কিন্তু কাগজপত্র নেই। আর পটুয়াখালী-বরগুনায় রাখাইনদের জমির কাগজপত্র আছে কিন্তু দখল নেই। এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না, যাদের এক বা একাধিক ভূমির মামলা নেই।

সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভূমি সুরক্ষায় পৃথক একটি ভূমি কমিশনের দাবি দীর্ঘদিন ধরে করছে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংগঠন ও আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের উপদেষ্টা রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সংসদে একাধিকবার কথা বলেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।’