গোলাম শরীফকে কেন সমর্থন দিলেন কাদের মির্জা, যা বলছেন অন্য প্রার্থীরা

কাদের মির্জা ও গোলাম শরীফ চৌধুরী

এক সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও প্রায় দুই যুগ ধরে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। দলের কোনো কর্মসূচিতেও তাঁকে দেখা যায়নি। এরই মধ্যে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর হঠাৎ তাঁর আগমন। এরপর গতকাল বুধবারের নির্বাচনে তিনি হয়ে যান নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। নাম তাঁর গোলাম শরীফ চৌধুরী ওরফে পিপুল। যদিও নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে সিল মারা, এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া, যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁদের বের করে দেওয়া, ভোটারদের প্রকাশ্যে সিল মারতে বাধ্য করাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোটের দিন সকাল ১০টায় ভোট বর্জন করেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এত অনিয়মের মধ্য দিয়ে গোলাম শরীফ চৌধুরীর বিজয় নিশ্চিত করতে যে ব্যক্তিটি মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি হলেন বসুরহাট পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কাদের মির্জা। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ছিলেন ওবায়দুল কাদেরের আরেক ছোট ভাই মো. শাহদাত হোসেনও। প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। কিন্তু কাদের মির্জা নিজের আপন ভাই কিংবা দলের নেতার পক্ষে কাজ করেননি। কাজ করেছেন তাঁর পছন্দের প্রার্থী গোলাম শরীফ চৌধুরীর পক্ষে। সঙ্গে যুক্ত করেছেন নিজের ছেলে তাশিক মির্জা ও ভাগনেদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা প্রথম আলোকে বলেন, দলের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে নিজের হাতের মুঠোয় নেওয়ার জন্যই কাদের মির্জা ওই পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি গোলাম শরীফের প্রায় প্রতিটি পথসভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রচারণায় মাঠে নামিয়েছেন তাঁর ছেলে তাশিক মির্জা ও ভাগনেদের। নিজের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানদেরও বাধ্য করেছেন। তাঁরাও উন্নয়নকাজের ভাগ পাওয়ার আশায় কাদের মির্জার কথার বাইরে যাননি।

আপন ভাই হয়েও ভাইয়ের পক্ষে কাজ না করার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই মো. শাহদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি আমার পক্ষে কাজ করলে তো আমি তাঁকে টাকা দিতে পারতাম না। আমার কাছে কোনো টাকা নেই। দেখা যেত, তাঁকে উল্টো আমার জন্য টাকা খরচ করতে হতো। এ কারণে তিনি (কাদের মির্জা) আমার পক্ষে কাজ করেননি। দলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, এমন ব্যক্তিকে এনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করিয়েছেন। এ জন্য কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।’

শাহদাত হোসেন আরও বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের কোথায়ও দলীয়ভাবে কোনো প্রার্থী মনোনয়ন দেয়নি। কোম্পানীগঞ্জেও দলীয়ভাবে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাঁর ভাই কাদের মির্জা তাঁর পছন্দের প্রার্থী গোলাম শরীফ চৌধুরীকে সব জায়গায় দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আর তাঁকে (শাহদাত) প্রার্থী হওয়ায় নানাভাবে হয়রানি করেছেন। প্রার্থিতা ফিরে পেতে তাঁকে দফায় দফায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে। আদালতের কাছ থেকে তিনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন, কিন্তু ন্যায়বিচার পাননি স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে। প্রশাসন সম্পূর্ণ কাদের মির্জার কথামতো কাজ করেছে। প্রায় প্রতিটি কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। ৩৫টি কেন্দ্র দখল করা হয়েছে, প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

উপজেলা পরিষদকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখার উদ্দেশ্যে গোলাম শরীফ চৌধুরীকে প্রার্থী করানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ভোট বর্জনকারী আরেক প্রার্থী মিজানুর রহমানও। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কাদের মির্জা হলেন পৌরসভার মেয়র। তিনি চেয়েছেন এমন একজনকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানাবেন, যিনি থাকবেন তাঁর হাতের পুতুল। যেভাবে নাচাবেন, সেভাবেই নাচবেন। কাদের মির্জা প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারের সভায় বলেছেন, গোলাম শরীফ এলাকায় কাজ না করলে তিনি করবেন। যেকোনো প্রয়োজনে তাঁরা যেন তাঁর কাছে যান।

মিজানুর রহমান বলেন, সকাল আটটার আগেই ৩৫টি কেন্দ্র কাদের মির্জার ছেলে ও তাঁর ভাগনেদের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণে নেন। তাঁরা প্রকাশ্যে সিল মারতে ভোটারদের বাধ্য করেন। এ কারণে বেলা ১১টায় তিনি ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কাদের মির্জার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।

স্থানীয় রাজনীতিতে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর হঠাৎ এসে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজয়ী চেয়ারম্যান গোলাম শরীফ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ছিলেন, এটা ঠিক নয়। তিনি বসুরহাট পৌরসভা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হন। এরই মধ্যে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হন।

টাকা নিয়ে তাঁকে কাদের মির্জার সমর্থন দিয়েছেন মর্মে শাহদাতের অভিযোগ ঠিক নয় বলে দাবি করেন গোলাম শরীফ চৌধুরী। তিনি বলেন, এখানে অনেক মানুষ তাঁর জন্য টাকা খরচ করেছেন। এখানে ওবায়দুল কাদেরের পরের স্থান তাঁর (কাদের মির্জার)। এখানকার রাজনীতি তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন ৪৫ বছর ধরে। উন্নয়নকাজ তিনি নিজের মতোই করবেন।

প্রসঙ্গত, গোলাম শরীফ চৌধুরী কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য (তৎকালীন নোয়াখালী-৪ আসন) আবু নাছের চৌধুরীর নাতি। আবু নাছের ১৯৭৩-৭৫ সাল পর্যন্ত ওই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁর বাবা কামাল পাশা চৌধুরীসহ গোটা পরিবার আগে থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। গোলাম শরীফ তাঁর শ্বশুরের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এলিন ফুডের পরিচালক।