পাঁচ দশক ধরে ভাড়া তোলাই কাজ এই সরকারি প্রতিষ্ঠানের

অনেকটা আড়ালে রয়েছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠান। ৪০ কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকলেও দৃশ্যত কোনো কাজ নেই।

আদমজী সন্স লিমিটেডের কার্যালয় এই আদমজী কোর্ট ভবনে
ছবি: প্রথম আলো

পাঁচ দশক ধরে ভবন ভাড়া দেওয়া ও ভাড়া তোলার কাজ করছে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে দৃশ্যত আর কোনো কাজ নেই আদমজী সন্স লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানের। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমানে তিনটি ভবন রয়েছে।

রাজধানীর মতিঝিলে জনতা ফোয়ারার পাশে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের ৭০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুমোদিত জনবল কাঠামো রয়েছে। বর্তমানে এসব পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৪০ কর্মকর্তা–কর্মচারী। এর বাইরেও নিরাপত্তা প্রহরীর মতো আউটসোর্সিংয়ে কিছু কর্মচারী রয়েছেন। তাঁরা ভাড়া আদায়ের পাশাপাশি ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের টুকটাক কাজও করে আসছেন। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা ও এসব সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে প্রতিষ্ঠানটি ২০২১–২২ অর্থবছরে খরচ করেছে প্রায় আট কোটি টাকা।

তিনটি ভবনের ভাড়া আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের এই প্রতিষ্ঠানের এত জনবলের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে ব্যয় কমানোর সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল রেখে বাকি ব্যক্তিদের পাওনা বুঝিয়ে দায়মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে।

এই প্রতিষ্ঠানে ব্যয় কমানোর সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল রেখে বাকি ব্যক্তিদের পাওনা বুঝিয়ে দায়মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

যেভাবে এল আদমজী সন্স

এই ভূখণ্ডে আদমজী সন্স লিমিটেডের যাত্রা ১৯৫২ সালে। দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানের নাগরিকদের সম্পত্তি সরকার গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি আদমজী গ্রুপের যাবতীয় শিল্প ও কোম্পানির সম্পদ ও দায়-দেনা গ্রহণ করে সরকার।
আদমজী গ্রুপের সম্পত্তিগুলো সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। তার মধ্যে জাতীয় চা বোর্ডের অধীনে যায় টি এস্টেটগুলো (পাত্রখোলা, মাধবপুর, চামপারাই, কেওয়াচেরা ও লাক্কাতুরা) এবং অ্যারোমা টি, চিনি ও খাদ্য করপোরেশনের অধীনে ন্যাশনাল সুগার মিলস ও ঢাকা ভেজিটেবলস, ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের অধীনে ন্যাশনাল টিউবস, জীবন বীমা করপোরেশনের অধীনে আদমজী ইন্স্যুরেন্স এবং বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় আদমজী পাটকল। এ ছাড়া আদমজী গ্রুপের মালিকদের বসবাসের জন্য নির্মিত বাসভবন পদ্মা ও মেঘনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অবশিষ্ট থাকে আদমজী সন্স লিমিটেড। এর বিভিন্ন শেয়ার ও দায়-দেনা থাকায় আদমজী গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং এজেন্ট হিসেবে পৃথক আইনি সত্তা থাকায় এবং দলিল–দস্তাবেজের সংরক্ষক হওয়ায় আদমজী সন্সকে গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রণালয় নেয়নি বা নেওয়ার আইনি সুযোগ ছিল না।

ফলে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি আদমজী সন্সে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার। বর্তমানে পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব তাঁর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে আদমজী সন্সের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিতে অন্তত ৪৭ কর্মকর্তা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

অযত্ন, অবহেলা থাকলেও রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকার এসব ভবন থেকে যে ভাড়া আসে, তাতে লাভজনক অবস্থায় আছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১–২২ অর্থবছরে আদমজী সন্সের আয় ছিল প্রায় ১৭ কোটি ৮ লাখ টাকা। আর ব্যয় ছিল প্রায় ৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছর ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয় ছিল। যদিও সম্প্রতি বড় একটি প্রতিষ্ঠান ভাড়া ছেড়ে দেওয়ায় লাভে কিছুটা ভাটা পড়েছে।

তিন ভবনে ১৩ জন লিফটম্যান

আদমজী সন্সে যে ৪০ জন কর্মরত আছেন, তাঁদের মধ্যে কর্মকর্তা হিসেবে উপমহাব্যবস্থাপক একজন, সহকারী ব্যবস্থাপক একজন, উপসহকারী ব্যবস্থাপক দুজন, কম্পিউটার প্রোগ্রামার একজন ও বিল্ডিং সুপারভাইজার হিসেবে একজন আছেন। কর্মচারী হিসেবে বাকি ব্যক্তিরা বিভিন্ন পদে কর্মরত। এর মধ্যে লিফটম্যান হিসেবেই আছেন ১৩ জন।

লিফটম্যান হিসেবে এতজন কেন কর্মরত, জানতে চাইলে আদমজী সন্সের কর্মকর্তারা জানান, দেশে যেসব ভবনে প্রথম লিফট স্থাপন করা হয়, তার মধ্যে এই প্রতিষ্ঠান অন্যতম। তখনকার লিফট এখনকার মতো স্বয়ংক্রিয় ছিল না। ফলে অধিকসংখ্যক লিফটম্যানের প্রয়োজন হতো। এখন স্বয়ংক্রিয় হলেও আগের জনবল রয়ে গেছে।
মতিঝিলে আমদজী সন্সের ভবন তিনটি হলো আদমজী কোর্ট মূল ভবন, আদমজী কোর্ট এনেক্স ভবন–১ ও আদমজী কোর্ট এনেক্স ভবন–২। এই তিন ভবনে মোট ছয়টি লিফট রয়েছে।

সম্প্রতি আদমজী কোর্ট মূল ভবনে দুজন লিফটম্যানের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা লিফটের সামনে দুটি টুলে বসে গল্প করছিলেন। স্বয়ংক্রিয় হওয়ায় তাঁদের লিফটের ভেতর থাকতে হয় না, বাইরেই বসে থাকেন।

আপনাদের কাজ কী জানতে চাইলে তাঁদের মধ্যে একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজ কী মানে? স্যারেরা নামতে–উঠতে গেলে লিফট তাঁদের জন্য ফাঁকা রাখি। আবার লিফট আটকে গেলে খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করি।’

এই দুজন লিফটম্যান জানান, চার ঘণ্টা করে তাঁরা পাঁচজন এই ভবনে দায়িত্ব পালন করেন। কর্মকর্তারা বলছেন, স্বয়ংক্রিয় হওয়ায় তিন ভবনে তিনজন লিফটম্যান থাকলেই হতো। কিন্তু জনবল আগে থেকেই থাকায় তাঁদের পালা করে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে।

ভবনের ৫২ হাজার বর্গফুট জায়গা ফাঁকা

আদমজী সন্সের সম্পত্তি বলতে এখন মতিঝিলের প্রায় ৪৯ কাঠা জমির ওপর নির্মিত বহুতল ভবন তিনটিই। তার মধ্যে মূল ভবন ও এনেক্স ভবন–১ ভবন দুটি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। পরবর্তী সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে এনেক্স–২ ভবনটি নির্মাণ করেছে তারা।
তার মধ্যে এনেক্স–১ ভবনের মালিকানা নিয়ে জীবন বীমা করপোরেশনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে আদমজী সন্সের। ফলে ছয়তলা এই ভবনের একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কারও কাছ থেকে ভাড়া আদায় করতে পারে না তারা। বর্তমানে তিনটি ভবনে মোট ৪০টি ভাড়াটিয়া প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

তবে ছয়তলার মূল ভবন ও ১৩ তলার এনেক্স–২ ভবনের অনেক জায়গাই ফাঁকা রয়ে গেছে। মতিঝিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায়ও তারা ভাড়াটিয়া খুঁজে পাচ্ছে না। জানা গেছে, এই দুই ভবনের ৫২ হাজার ৬৫০ বর্গফুট জায়গা এখন ফাঁকা পড়ে আছে।

প্রতি বর্গফুট জায়গা বর্তমানে তারা ৭৫ টাকা দরে ভাড়া দিচ্ছে, দর–কষাকষি করলে কিছু কমও রাখছে। কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার পর থেকে ভাড়াটিয়া কমছে। সম্প্রতি একটি বড় প্রতিষ্ঠান চলে গেছে, এতে বেশি ফাঁকা হয়ে পড়েছে।

সরকারের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইট থাকলেও আদমজী সন্সের নেই। তারা যে ভবন ভাড়া দেয়, কত দরে দেয়, ভাড়ার জন্য কার সঙ্গে যোগাযোগ করবে—এসব তথ্যের কোনোটাই মানুষ পায় না। ফলে মূল ভবনের চতুর্থতলায় আদমজী সন্সের প্রধান কার্যালয়ে যাওয়া ছাড়া যোগাযোগের সুযোগ নেই। ভবন ফাঁকা পড়ে থাকার এটি একটি অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

যে ধরনের কর্মকাণ্ড চলে

যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের ছাপ তাদের নোটিশ বোর্ডে কিছুটা হলেও পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে আদমজী সন্সও ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়।

আদমজী কোর্টের মূল ভবনের চতুর্থ তলার একাংশে আদমজী সন্সের কার্যালয়। কার্যালয়ে প্রবেশ করতেই বাঁ পাশে তাদের নোটিশ বোর্ড। ১৭ আগস্ট গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বেশকিছু নোটিশ জারি করা আছে। বাইরে থেকে চারটি নোটিশ পড়া যাচ্ছিল। তার মধ্যে সব৴শেষ নোটিশ জারি করা হয় ১৪ আগস্ট, যেখানে জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত মিলাদ ও দোয়ায় কর্মকর্তা–কর্মচারীদের অংশগ্রহণের জন্য বলা হয়।

এর আগে ১৮ জানুয়ারি বনভোজন এবং ৯ ও ১৪ মার্চ আদমজী সন্সের কর্মচারী ইউনিয়নের নির্বাচন নিয়ে দুটি নোটিশ জারি করা হয়। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানের আর কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না।

কর্মকর্তাদের সন্তোষ, কর্মচারীদের অসন্তোষ

আদমজী সন্সের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটিকে একটু আড়ালে রাখতে চান। সে জন্য তাঁরা এখনো নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি করেননি। আবার তাঁদের নিজস্ব তিনটি ভবনের কোথাও বড় করে আদমজী সন্সের নাম দেখতে পাওয়া যায় না। ফলে প্রতিষ্ঠানটির আশপাশের মানুষের কাছেই তাঁরা অপরিচিত।

সম্প্রতি আলাপচারিতায় প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বস্ত্র ও পাটকল মন্ত্রণালয়ের একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান আমরা। এটার দিকে যদি কারও নজর পড়ে, বোঝেন না, দিনকাল ভালো না। দেখবেন, পুরোটাই নিয়ে যাবে। নেগেটিভ নিউজ হলে ওরা বলবে, এটাকে প্রাইভেটে দিয়ে দিই। আমরা কিছু টাকা জমিয়েছি, সেগুলো লুটপাট করে খেয়ে ফেলবে। এখন আমরা ভালো আছি।’

তবে কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। কর্মচারীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা একই পদে আছেন। যা বেতন পান, তা দিয়ে বর্তমান বাজারের সঙ্গে তাঁরা তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না। প্রতিষ্ঠানটি ভাড়া থেকে যে আয় করে, সেখান থেকেই বেতন–ভাতা হয়ে থাকে। তাঁদের জন্য পেনশন সুবিধা নেই।

কাঠামো ঠিক রেখে হতে পারে সংস্কার

পাকিস্তান আমলে নির্মিত আদমজী কোর্ট মূল ভবন ও এনেক্স ভবন–১–এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ভবনের সামনে গাছপালা ও দুপাশে সারি সারি ভবনের কারণে স্থাপনা দুটি খুব একটা দৃশ্যমান নয়। অবশ্য মূল ভবনের ভেতরে প্রবেশ করলে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী চোখে পড়ে। তবে ধুলাবালি, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও যত্নের অভাব রয়েছে ভবনে, সেটি স্পষ্ট।

যদিও মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০ কাঠার ওপর প্রতিষ্ঠিত আদমজী কোর্ট মূল ভবন ভেঙে অত্যাধুনিক বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করতে চায় কর্তৃপক্ষ।

অবশ্য সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আদমজী সন্স সরকারের কোনো করপোরেশনের অধীনে না থাকায়, লাভজনক হওয়ায় এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকায় ভবনের মূল স্থাপত্য শৈলী পরিবর্তন করা ঠিক হবে না।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ভবন ভেঙে বহুতল ভবন করা ঠিক হবে না। ভবনগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকায় আদি কাঠামো ঠিক রেখেই সংস্কার করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান কাঠামোতেই পরিচালনা হতে পারে।

অবশ্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পাট) ও আদমজী সন্সের উপপ্রশাসক তসলিমা কানিজ নাহিদা প্রথম আলোকে বলেন, আজমজী সন্সের এখন প্রধান কাজ ভবন ভাড়া দেওয়া ও ভাড়া তোলা। আপাতত এভাবেই চলবে। এর বাইরে কোনো পরিকল্পনা নেই।