স্বাস্থ্যসচেতন পাখিটি

কর্ণফুলী নদীর পাড়ের কাদা থেকে মাছ ধরে ধুতে নিয়ে যাচ্ছে একটি কানিবক
ছবি: লেখক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী ড. মো. আতাউর রহমান এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিচিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র মো. ইয়াছিন হায়দার চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে কর্ণফুলী নদীর এক চরে পরিযায়ী পাখির সন্ধানে ঘুরছিলাম। পাখি পর্যবেক্ষণ শেষে ফিরতি পথে নদীতে ভাসমান বদর কৈতরের (ব্রাউন-হেডেড গাল) ছবি তুলছিলাম।

এমন সময় হঠাৎই নদীর পাড়ে কাদায় একটি পাখিকে কিছু একটা খুঁজতে দেখলাম। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ওর কাজকর্ম দেখতে থাকলাম ও শাটারে সমানে ক্লিক করে গেলাম। পাখিটি কাদা থেকে একটি শিং মাছ শিকার করে সেটাকে মুখে নিয়ে হেঁটে হেঁটে পানির সামনে এল এবং মাছটিকে কয়েকবার পানিতে আছড়ে ধুয়ে পরিষ্কার করল।

পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেলে সেই মাছটিকে গপ করে গলায় ঢুকিয়ে দিয়ে তৃপ্তি করে খেল। জীবনে এ ধরনের দৃশ্য খুব কমই দেখেছি! পাখিদের মধ্যে এ রকম স্বাস্থ্যসচেতনতা দেখে যারপরনাই অভিভূত ও আশ্চর্য হলাম! অথচ এখনো আমাদের অনেকের মধ্যেই স্বাস্থ্যসচেতনতার লেশমাত্র নেই। পাখি পর্যবেক্ষণে গিয়ে প্রতিনিয়তই ওদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখছি। সত্যিই অতুলনীয়!

স্বাস্থ্যসচেতন এই পাখির আকার মাঝারি। দৈর্ঘ্য ৪৫ থেকে ৪৬ সেন্টিমিটার, প্রসারিত অবস্থায় ডানার মাপ ৭২ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার এবং ওজন ২১৫ থেকে ২৩০ গ্রাম। মাথা কালচে-বাদামি বর্ণের। ঘাড়ে হলদে-পীতাভ রঙের লম্বালম্বি টান রয়েছে। কাঁধ-ঢাকনি, পিঠ ও ডানা-ঢাকনি বাদামি। থুতনি ও গলা সাদা। বুক সাদা ও তাতে অনেকগুলো লম্বালম্বি বাদামি টান রয়েছে।

পেট-তলপেট সাদা। চোখের রং হলুদ। হলুদাভ চঞ্চুর আগা কালচে। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল অনুজ্জ্বল সবুজাভ-হলুদ। কিন্তু প্রজনন মৌসুমে ওদের মাথার রং হয় হলদে-পীতাভ। পিঠ ও ঘাড় হয় মেরুন-বাদামি। ঘাড়ের পেছনে সাদা ঝুঁটি ফুটে ওঠে। সবুজাভ-হলুদ চঞ্চুর গোড়া হয় নীল। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল হয় সবুজ। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির বুকে হালকা বাদামি তিল ও কাঁধ-ঢাকনিতে পীতাভ লম্বালম্বি টান দেখা যায়।

ঢাকাসহ পুরো দেশের বিভিন্ন ধরনের জলাভূমি ও জলপূর্ণ জমিতে এই পাখিগুলোকে একাকী বা বিচ্ছিন্ন ছোট দলে বিচরণ করতে দেখা যায়। স্বল্প পানিতে ঠায় দাঁড়িয়ে বা ধীরে ধীরে হেঁটে মাছ, ব্যাঙ, জলজ কীটপতঙ্গ, কাঁকড়া, চিংড়ি ইত্যাদি শিকার করে খায়। শীতকালে সচরাচর নীরব থাকলেও গ্রীষ্মকালে ওরা উচ্চ স্বরে ‘ওয়া-কু—ওয়া-কু—ওয়া-কু—-’ শব্দে বারবার ডাকতে থাকে।

স্বাস্থ্যসচেতন পাখিগুলো প্রজনন করে জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে। অন্যান্য জলচর পাখির সঙ্গে বড় গাছ বা বাঁশঝাড়ে মিশ্র কলোনি গড়ে; শুকনো সরু ডালপালা, চুল ও পালক দিয়ে মাচার মতো বাসা বানায়। পুরুষ বাসা তৈরির সরঞ্জাম জোগাড় করে ও স্ত্রী সেগুলো দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে তিন-পাঁচটি, রং সবুজ।

ডিমে তা দেওয়া ও ছানাদের লালনপালনের কাজ স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে করে। ডিম ফোটে ১৮ থেকে ২৪ দিনে। ছানারা ২৬ থেকে ৩৫ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল ৬ থেকে ৭ বছর।

কর্ণফুলী নদীতে দেখা স্বাস্থ্যসচেতন এই পাখি আর কেউ নয়, এ দেশের বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি কানিবক। কানা বক, কোঁচ বক বা গুজি বক নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম পন্ড হেরন বা ইন্ডিয়ান পন্ড হেরন। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Ardeola grayii। ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বকটির বিস্তৃতি রয়েছে।

আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখিবন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ