আমাদের আকাশও আজ কাঁদছে
কী গভীর দুঃখ, কী দুর্বহ শোকের খবরই না পড়তে হচ্ছে আমাদের। দেখতে হচ্ছে হৃদয়বিদারক ছবি, রক্ত হিম করা ভিডিও। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হলো একটা শিক্ষায়তনে গিয়ে। ২১ জুলাই ২০২৫। মেঘে ঢাকা বিবর্ণ দিনটায় বেলা ১টা ১৮ মিনিটে বিমানটি আঘাত করে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটা ভবনে।
ছবিতে আমরা দেখছি, বিমানটা ভবনের ভেতরে সেই ঘরে ঢুকে গেছে, যেখানে ক্লাস করছিল প্রাথমিক স্কুলের হাসিখুশি শিশুরা। স্কুল ছুটির পর সেখানে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের কোচিং ক্লাস হবে। সে জন্যও এসেছিল শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আগুন জ্বলে উঠল! আমরা ছবি দেখেছি। তাকানো যায় না এমন সব ছবি। কাপড়চোপড় পুড়ে গেছে, এক শিক্ষার্থী ছুটে যাচ্ছে। উদ্ধারকারীর কোলে কাপড়ে ঢাকা ছোট্ট দেহ। আহা, কী কষ্ট পেয়েই না প্রাণ হারিয়েছে শিশুটা।
স্কুলের হাজারো শিক্ষার্থীর উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা ছুটে গেছেন, সন্তানকে খুঁজে পাচ্ছেন না। একজন মা কাঁদছেন, প্রথম আলোয় আমরা পড়ছি, বড় ছেলেটাকে পেয়েছি, ছোটটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। প্রথম আলোর সাংবাদিক সেলিম জাহিদের ঠিক পাশের চেয়ারে বসে এই লেখাটা লিখছি। সেলিম জাহিদ তাঁর ছেলে সায়েরকে খুঁজে পাচ্ছেন না, স্ট্যাটাস দিয়েছেন ফেসবুকে। নিখোঁজ হওয়ার চার ঘণ্টা পর জানা গেল, ছেলেটিকে খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু বহু মা-বাবা আর স্বজন পাগলের মতো ছুটছেন একবার কলেজের গেটে, একবার হাসপাতালে, এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। এক স্বজনের বিলাপ শুনছি ভিডিওতে, আমার বাচ্চা নাই, সিএমএইচে তার লাশ, সে আগুনে পুড়ে মারা গেছে...
আহা! এই ছেলেমেয়েরা সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল। ইউনিফর্ম পরেছিল। আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়েছিল। টিফিন বক্স সাজিয়ে দিয়েছিলেন মা। ওরা স্কুলে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পর যদি দুর্ঘটনা ঘটত, ওদের অনেকেই বেঁচে যেত—স্বজনদের এই আফসোস তো যাবে না। শিক্ষার্থীদের আনতে যাওয়া অভিভাবক বা শিক্ষকদের মধ্যে কতজন নিহত বা আহত হয়েছেন, আমরা এখনো জানি না। এই লেখা যখন লিখছি, সে পর্যন্ত মারা গেছেন পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামসহ ২০ জন। আহত ১৭১ জন। বার্ন ইউনিট থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছে অনেকেই। আগুনে পোড়া শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষদের অনেকের অবস্থা সংকটপূর্ণ।
ছবিতে আমরা দেখছি, বিমানটা ভবনের ভেতরে সেই ঘরে ঢুকে গেছে, যেখানে ক্লাস করছিল প্রাথমিক স্কুলের হাসিখুশি শিশুরা। স্কুল ছুটির পর সেখানে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের কোচিং ক্লাস হবে। সে জন্যও এসেছিল শিক্ষার্থীরা।
প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে এক শিক্ষার্থীর কথা। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী কাব্য। বেলা একটার দিকে কাব্যর ক্লাস শেষ হয়ে গিয়েছিল। বের হয়ে আসছিল সে। এ সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়।
কাব্য প্রথম আলোকে বলেছে, ‘বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ধরে যায়। যে ভবনে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেটি দোতলা ছিল। ক্যানটিনের পাশেই ভবনটি। সেখানে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস হতো। বেলা একটার দিকে তাদের ছুটি হয়ে যায়। তবে তখনো কিছু শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান করছিল। আহত অনেককে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল হাসপাতাল ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আহতদের জন্য প্রচুর রক্ত লাগবে। রক্ত দিতে আগ্রহীদের অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হচ্ছে।’
প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে হাসপাতালে রোদনরত এক মায়ের কথা। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর কক্ষের মেঝেতে মেয়েকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন ইয়াসমিন আক্তার। তাঁর ১১ বছর বয়সী পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে নুরে জান্নাত ইউশা বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় পুড়ে গেছে।
আহা! এই ছেলেমেয়েরা সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল। ইউনিফর্ম পরেছিল। আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়েছিল। টিফিন বক্স সাজিয়ে দিয়েছিলেন মা। ওরা স্কুলে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পর যদি দুর্ঘটনা ঘটত, ওদের অনেকেই বেঁচে যেত—স্বজনদের এই আফসোস তো যাবে না।
ইয়াসমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়ের কপাল পুড়ে গেছে, মুখ ঝলসে গেছে, মাথা ফেটে গেছে, পিঠও পুড়ে গেছে। আমার মেয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। মেয়ে বলে, মা, আমার সব জ্বলে।’
এতগুলো শিশু মারা গেছে। নিয়তির এ কী নির্মম আঘাত! স্কুলে শিশুরা যায় আমাদের স্বপ্নগুলো সঙ্গে নিয়ে, একেকজন একেকটা বিশাল সম্ভাবনা ধারণ করে। আমাদের প্রতিটি সন্তানের সঙ্গে এত স্মৃতি, ছোট থেকে একটু একটু করে বড় করার এত অভিজ্ঞতা, এত মান-অভিমান-ভালোবাসা! ছেলেটা বা মেয়েটা স্কুলে গেল, আর ফিরল না।
এ রকম কত শিশুর, শিক্ষার্থীর, মানুষের সবকিছু জ্বলে গেছে। বইপত্র পুড়ে গেছে, গায়ের পোশাক পুড়ে গেছে, হাত-পা-চুল-চোখের পাতা আর গায়ের চামড়া পুড়ে গেছে। পুড়ে একেবারে অঙ্গার হয়ে গেছে, এমন ছবিও ছড়িয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। যে শিশুরা আহত হয়েছে, ওদের কষ্টের কোনো শেষ নেই। আর সন্তানহারা মা-বাবার কষ্টের অনুভূতি তো আমরা কল্পনাও করতে পারব না। সহানুভূতি, সমানুভূতি—কোনো কিছুই তাদের জায়গায় আজ আমাদের বসাতে পারবে না। নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতা আছে: ‘আকাশ যেমন বিমানের চেয়ে বড়, তেমনি আমার বেদনা বক্ষ থেকে।’ আজ আমাদের বেদনা আমাদের বক্ষ থেকে বড় হয়ে উঠেছে। আমাদের আকাশও আজ কাঁদছে।
এতগুলো শিশু মারা গেছে। নিয়তির এ কী নির্মম আঘাত! স্কুলে শিশুরা যায় আমাদের স্বপ্নগুলো সঙ্গে নিয়ে, একেকজন একেকটা বিশাল সম্ভাবনা ধারণ করে। আমাদের প্রতিটি সন্তানের সঙ্গে এত স্মৃতি, ছোট থেকে একটু একটু করে বড় করার এত অভিজ্ঞতা, এত মান-অভিমান-ভালোবাসা! ছেলেটা বা মেয়েটা স্কুলে গেল, আর ফিরল না। এমন মৃত্যুও হতে পারে!
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিন্নমুকুল’ কবিতায় আছে:
সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট,
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।
একগুচ্ছ ছিন্নমুকুলের শোকে আজ বাংলাদেশ কাঁদছে। আমরাও কাঁদছি। কারও প্রতি আজ কোনো অভিযোগ নেই, আমরা আজ শুধু কাঁদব। আমরা শোক জানাই, সমবেদনা জানাই। প্রথম আলো পরিবার, কিশোর আলো, বিজ্ঞানচিন্তা, প্রথম আলো ট্রাস্ট ও প্রথম আলো বন্ধুসভার পক্ষ থেকে শোক জানাই। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি, থাকব। পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধ বাড়িয়ে দেব, আপনার চোখের জল আমাদের চোখে ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করব।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই বিপদ, এই শোক সামলানোর শক্তি দিন।