সাদা মেঘের ভেলা

নীল আকাশে ভাসছে শিমুল তুলার মতো সাদা মেঘের ভেলা। নিচে সবুজ পাহাড়। শরতে মেঘ-পাহাড়ের মিতালিতে নয়নাভিরাম হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। রাঙামাটি সদরের মগবান ইউনিয়নের ওগেয়েছড়ি থেকে ছবিটি তুলেছেন সুপ্রিয় চাকমা
নীল আকাশে ভাসছে শিমুল তুলার মতো সাদা মেঘের ভেলা। নিচে সবুজ পাহাড়। শরতে মেঘ-পাহাড়ের মিতালিতে নয়নাভিরাম হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। রাঙামাটি সদরের মগবান ইউনিয়নের ওগেয়েছড়ি থেকে ছবিটি তুলেছেন সুপ্রিয় চাকমা

বদলে গেছে মেঘের রং। আকাশে এক পলক তাকালেই চোখে পড়বে—মাত্র কিছুদিন আগেও যে ধূমল, কালো গম্ভীর মেঘ ছেয়ে থাকত দিকচক্রবাল, তারা আর নেই। সুনীল অন্তরীক্ষে ভেসে বেড়াচ্ছে শিমুল তুলার মতো ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের টুকরা। দেখলেই মনে হয় ওগুলো খুবই কোমল আর হালকা। মতিগতির ঠিক নেই। এই ভাসতে ভাসতে আকাশের এক কোণে এসে জড়ো হচ্ছে। স্তূপ হয়ে উঠছে অদ্ভুত সব আকৃতি নিয়ে। পরক্ষণেই আবার এলোমেলো। টুকরা টুকরা হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশে। 
নীল আকাশের পটভূমিতে বিচিত্র আকারের সাদা মেঘের এই বিপুল সন্নিবেশ, এক সূচিস্নিগ্ধ আবেশ রচনা করেছে মাথার ওপরে। বৃষ্টির রেশ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। উদয়াস্ত প্রখর রোদ বিলিয়ে যাচ্ছে সূর্য। তার ছটায় দ্যুতিময় হয়ে ওঠে পেঁজা পেঁজা মেঘের কিনার। সন্ধ্যার শোভা আরও মনোহর। পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়া সূর্যকে তখন মনে হয় আকাশের কপালে যেন এক টকটকে লাল টিপ। তার বিভায় রঙিন হয়ে ওঠে দিগন্ত। মেঘেদের গায়ে গায়ে হলুদ, কমলা, গোলাপি রঙের আভা। ডানায় বেলা শেষের রোদ মেখে নীড়ে ফিরে যাওয়ার সময় পাখির ঝাঁক হিংসা-বিদ্বেষ-জিঘাংসাকবলিত পৃথিবীকে কলকাকলীতে শুনিয়ে যায় বিশুদ্ধ প্রেমের সংগীত। এ রকম মুহূর্তেই বোধ হয় বড় বেশি করে মনে পড়ে ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে...’।
বাংলার প্রকৃতি এখন শুধু সুন্দরই নয়, স্নিগ্ধ কোমলও। ভাদ্র বিদায় নিচ্ছে। শরতের অর্ধেক পেরিয়ে যাচ্ছে। এবার বর্ষা এসেছিল বেশ বিলম্বে। শরতের প্রথমার্ধজুড়েই থেকেছে বৃষ্টি-বজ্রের দাপট। ক্রমে সেই পরাক্রম স্তিমিত হয়ে শরৎ ফিরেছে আপন রূপে। এই রাজধানী মহানগরে শরতের প্রকাশ বলতে কেবল আকাশে ওই সাদা মেঘের ভেলা। তার অপর প্রধান অনুষঙ্গটির দেখা পেতে শহর ছাড়তে হবে। নদীর বাঁক, বালুচর, গ্রামগঞ্জের পতিত ময়দান বা বাঁধের পাশ দিয়ে কাশবন এখন ভরে উঠেছে শুভ্র ফুলে ফুলে। কাশবনের শোভা একটু দূর থেকেই ভালো লাগে। মনে হয় জমাট সবুজের ওপর যেন আকাশের সাদা মেঘের টুকরাগুলো আটকে দেওয়া। একেবারে কাছে গেলে ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা দেখায়। সেই কাশবনের ওপর থেকে থেকে ঢেউ তুলে বয়ে যায় ঝিরঝিরে হাওয়া। আর পাশে যদি বিলঝিল থাকে এবং তার টলটলে পানির বুকে বিছিয়ে থাকে কলমিলতা, ফুটে থাকে সফেদ শাপলার রাশি, তাহলে তো কথাই নেই। প্রকৃতির সেই রূপ-লাবণ্য থেকে চোখ ফেরানোই মুশকিল।
গ্রামবাংলায় এখন মাঠের পর মাঠজুড়ে দিগন্ত ছুঁয়ে আছে রোপা আমনের সবুজ বিস্তার। ঝলমলে রোদে সেই সবুজের ওপর ভেসে থাকা শরতের মেঘ, রোদ-ছায়ার দ্বন্দ্ব যে কাব্যিক আবহের সৃষ্টি করে চলে, কবিগুরু তা তুলে ধরেছিলেন ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা...’ এই গানে। এবার আকস্মিক বন্যায় উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় অবশ্য আমন ডুবে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে কৃষকের। তবে সে দায়-দোষ শরতের নয়। শরৎ তো বাংলার চিরকালের শান্ত-স্নিগ্ধ ঋতু। প্রথম পর্যায়ে তার খেয়ালি বৃষ্টি অবশ্য আচমকা পথচলতি পথিকদের খানিকটা ভিজিয়ে দেয় বটে, তবে সেই বৃষ্টি নিতান্তই ক্ষণিকের। মাঝনাগাদ থেকে ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও আর থাকে না। খাল-বিল, নদ-নদী সদ্যবিগত বর্ষা অবদানে ভরা টইটম্বুর। বর্ষার প্রচুর জলধারায় গাছগাছালি বেড়ে ওঠে বুনো উচ্ছ্বাসে। পাতায়, বাকলে জমে থাকা ধুলা-ময়লা ধুয়ে গিয়ে শরতে তাদের দেখায় পরিচ্ছন্ন।
বাংলার ঋতুচক্রে সবচেয়ে স্নিগ্ধ এই ঋতুর সঙ্গে আনন্দ উৎসবের ঘটাও জড়িয়ে আছে। শরতের শেষ ভাগে মহাধুমধামের সঙ্গে শুরু হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। বরাবরের মতোই পূজার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এবারও। দশভুজা দেবীপ্রতিমা গড়ার কাজে এখন ব্যতিব্যস্ত সময় যাচ্ছে কুমারদের। সামনেই আশ্বিন, ঢাকের বাদ্যি, ঢোলের বোলে মুখর হয়ে উঠবে পরিবেশ।
ঋতুর চক্র নিরন্তর এভাবেই ঘুরে যায়। তার সঙ্গে পাওয়ার আনন্দ, হারানোর বেদনা, না পাওয়ার আক্ষেপের অম্লমধুর স্মৃতিসুধা নিয়ে বহতা নদীর মতো এগিয়ে যায় মানবজীবন।