সহিংস অপরাধ, দণ্ডপ্রাপ্তির হার এবং মানুষের নিরাপত্তা বোধ

বিষয়টা মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত যে দুর্নীতি বা এ রকম নৈতিক স্খলনজনিত অনেক অপরাধের বিষয়ে আমাদের দেশের অবস্থান তলানিতে। গত কয়েক বছরে দুর্নীতির সূচকে আমাদের বৈশ্বিক অবস্থানের তুলনামূলক সামান্য উত্তরণ ঘটেছে। এতে আমাদের ভূমিকা যতটুকু, তার থেকে বরং অন্য কিছু দেশের পিছিয়ে পড়ার অবদান বেশি।

আমাদের দেশে ঘুষ-দুর্নীতির মতো নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ঘুষ-দুর্নীতিকে আমরা হয়তো অপরাধ না বলে ‘প্রথা’ বা ‘নিয়ম’ বলেই মনে করি। এর পাশাপাশি যদি কেউ পত্রপত্রিকা খোলেন, তাহলে প্রায়ই লক্ষ করা যায় নানা রকম সহিংস অপরাধের ঘটনা; বিশেষত খুন, ধর্ষণ, মারামারি-সংঘর্ষ পত্রপত্রিকায় শীর্ষ সংবাদ হিসেবে চলে আসে।

তর্ক সাপেক্ষে বলা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে, এমনকি অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের থেকে বিভিন্ন সহিংস অপরাধের ঘটনা তুলনামূলক বেশি গুরুত্বসহ ছাপানো হয়। এ বিষয়ে যথেষ্ট মানসম্মত গবেষণা হয়েছে কি না বা নির্ভরযোগ্য তথ্য–উপাত্ত পাওয়া যাবে কি না, তা জানা নেই।

তবে মোটাদাগে বলা যায়, সহিংস অপরাধের দিক থেকে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে নেই। কিন্তু জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধসংক্রান্ত কার্যালয়ের (UNODC) তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলাদেশ খুন, ধর্ষণ, মারামারি, সংঘর্ষ—এ ধরনের কোনো অপরাধে জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ দেশগুলোর কাতারেও পড়বে না।

উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার কিছু দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে সহিংস অপরাধের সংখ্যা অনেক বেশি। অবশ্য এখানে পরিসংখ্যানগত একটা সীমাবদ্ধতা থাকার আশঙ্কা রয়েছে। কোনো দেশে নথিভুক্ত অপরাধ এবং নথিভুক্তহীন অপরাধের মধ্যে বেশ খানিকটা তারতম্য থাকার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কখনো কখনো অপরাধের শিকার ব্যক্তি নিজেই আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করতে না–ও পারেন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য অপরাধের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে গড়িমসি করতে পারেন।

স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে পড়াশোনার সময় সেখানকার জাতীয় পত্রপত্রিকায় পড়েছিলাম, সেখানে কয়েক মাসের মধ্যে কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছিল। বিষয়টি নিয়ে পত্রপত্রিকায় বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। তখন মনে হচ্ছিল, এমন খুনের ঘটনা আমাদের দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সিঙ্গাপুরের মতো একটা ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র এবং যেখানে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের (কারও কারও মতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও) জন্য ব্যাপকভাবে বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তার সঙ্গে আমাদের মতো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অতি জনবহুল একটা দেশের তুলনা অমূলক।

কিন্তু যদি পশ্চিমা বিশ্বের অনেক জাতীয় পত্রপত্রিকায় চোখ বোলানো হয়, তাহলে দেখা যাবে, সেখানে কিন্তু সাধারণত নিত্যনৈমিত্তিক সহিংস অপরাধের ঘটনা পত্রিকার শীর্ষস্থানীয় খবর হয় না বা তেমন একটা গুরুত্বও পায় না। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্র, যেখানে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ এবং আইন দ্বারা তেমনভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়, যেখানে খুনখারাবি মোটামুটি নিয়মিত ঘটনা, সেখানেও জাতীয় পত্রিকায় সহিংস অপরাধের ঘটনা তেমন একটা স্থান পায়, এমনটা দেখা যায় না।

অবশ্য যখন কোনো ‘নির্বিচার গুলি’র ঘটনা ঘটে থাকে, সেটা ভিন্ন কথা। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ বলতে পারেন, যা নিয়মিত ঘটে না, তাই সাধারণত খবর। তবে এই যুক্তি মানলে ধরে নিতে হয়, আমাদের দেশে সহিংস অপরাধের সংখ্যা ও মাত্রা সিঙ্গাপুরের মতো কম, যা কোনোভাবেই সত্য নয়।

বিশ্বের অনেক দেশের থেকে যদি আমাদের দেশ কম সহিংসতাপ্রবণ হয়, তাহলে অনেক সময় সহিংসতার হার নিয়ে যে বিভিন্ন রকম ধারণা বা দুশ্চিন্তা দেখা যায়, তার কারণ কী? এটা কি শুধু আমাদের সংবাদমাধ্যমের তৈরি করা কোনো আশঙ্কা? এই ধারণার পেছনে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সামান্য ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে।

কিন্তু মুখ্য কারণ আমাদের দেশে অপরাধের দণ্ডপ্রাপ্তির হার অতি নিম্ন। অপরাধের দণ্ডপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও আমাদের দেশে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু যে ধরনের গবেষণা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, আমাদের দেশে সহিংস অপরাধের ক্ষেত্রে দণ্ডপ্রাপ্তির হার মোটামুটি ১০ থেকে ১৫ শতাংশের থেকে বেশি হয় না। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এটি অনেক কম। যদি ধরেও নেওয়া যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধের অভিযোগগুলো মিথ্যা, তবুও বোধ হয় এটা অনুমান করা সংগত হবে যে বেশির ভাগ সহিংস অপরাধের অভিযোগ মিথ্যা নয়।

দণ্ডপ্রাপ্তির এত নিম্ন হার স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে সহিংস অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার পাওয়ার ব্যাপারে আস্থাশীল করে তুলতে পারছে না। আমরা তাই অনেক সময় দেখি, মানুষ বিচার চাইতে গিয়ে মানববন্ধন করেন, সংবাদ সম্মেলন করেন। আপাতদৃষ্টে এটা অনুমান করা যায় যে সহিংস অপরাধের ক্ষেত্রে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন হবে, এই বিষয়ে আমাদের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস খুব একটা নেই।

একজন ছিনতাইকারীকে বা পকেটমারকে পিটিয়ে মেরে ফেলা বা এমনকি একটি পরিবহন দুর্ঘটনার সময় কোনো পরিবহনচালককে নির্দয়ভাবে মারধর করার প্রবণতা—এটা অপরাধীর দণ্ডপ্রাপ্তির ব্যাপারে মানুষের অনাস্থার প্রমাণ বলা যায়।

আমাদের দেশে চাঞ্চল্যকর কোনো সহিংস অপরাধ হলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিজ্ঞ আইনজীবীদের কেউ কেউ কঠোর থেকে কঠোরতর ফৌজদারি আইনের দাবি করেন। কিন্তু যদি আমরা আমাদের মামলার তদন্তব্যবস্থাকে আরও আধুনিকীকরণ করতে না পারি, আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপরে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার বন্ধ করতে না পারি, তবে অপরাধীর দণ্ডপ্রাপ্তির হার বাড়ার আশা করা অমূলক। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর এই পাঁচ দশকে আমরা বিভিন্ন অপরাধ দমনসংক্রান্ত বিশেষায়িত আইন পাস করেছি, অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে কঠোর থেকে কঠোরতর বিধান করেছি, কিন্তু তার ফলে সহিংস অপরাধের মাত্রার তেমন গুণগত কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

সহিংস অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীর উপযুক্ত বিচার হবে, এই বোধ জোরদার করতে সক্ষম হতে হবে। সহিংস অপরাধ করার পরও কেউ যখন সমাজে ‘বুক ফুলিয়ে’ চলতে পারে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সহিংস অপরাধের হার যা–ই হোক না কেন, সাধারণ মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ থাকবে।

আবার সহিংস অপরাধের দণ্ডপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেলেই অপরাধের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে, বিষয়টি এমন সরলও নয়। কিন্তু অপরাধের দণ্ডপ্রাপ্তির হার বৃদ্ধি করা গেলে অন্তত মানুষের মনে নিরাপত্তাবোধ বাড়বে বলে আশা করা যায়।

মো. রিজওয়ানুল ইসলাম অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ; সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়