মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) যাত্রা শুরু ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল, ২৬ বছরে তা কতটা অর্জিত হয়েছে?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: এমটিবির যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘ট্রাস্ট’–কে মূল ভিত্তি হিসেবে রেখে। আমাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি ব্যাংক গড়ে তোলা, যেখানে গ্রাহক, কর্মী ও শেয়ারহোল্ডার—সবাই পারস্পরিক আস্থার বন্ধনে যুক্ত থাকবেন। ২৬ বছরের এই পথচলায় আমরা গ্রাহকের ভালোবাসা, অংশীদারদের আস্থা ও সমাজের স্বীকৃতি অর্জন করেছি। বর্তমানে এমটিবি একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও গ্রাহককেন্দ্রিক ব্যাংক হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। প্রতিটি পদক্ষেপেই আমরা বিশ্বাস রাখি, সেই অঙ্গীকারে—ইউ ক্যান ব্যাংক অন আস।
এই দীর্ঘ পথচলায় মূল চ্যালেঞ্জ কী কী ছিল? সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করেছেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নীতিনির্ধারকদের কোনো সহযোগিতা চান কি না?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: প্রতিটি দশকেই ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ এসেছে—প্রযুক্তি পরিবর্তন, নীতিগত রূপান্তর, এমনকি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে কোভিড–পরবর্তী সময়টা ছিল অত্যন্ত কঠিন। আমরা একে দলগতভাবে মোকাবিলা করেছি—নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা মেনে, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জোরদার করে এবং কর্মীদের মনোবল ধরে রেখে। ভবিষ্যতের জন্য আমরা চাই এমন নীতিগত সহযোগিতা, যা ব্যাংকগুলোকে উদ্ভাবনে উৎসাহ দেবে এবং টেকসই প্রবৃদ্ধিকে আরও সহজ করবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা তীব্র। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক কোন বিশেষত্বের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে নিজেদের আলাদা করেছে?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমরা প্রতিযোগিতাকে সব সময় ইতিবাচকভাবে দেখি। এমটিবি আলাদা, কারণ আমরা গ্রাহকের প্রয়োজন বোঝার চেষ্টা করি, পণ্য বিক্রি নয়—সমাধান দিই। আমাদের সেবায় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রযুক্তিনির্ভর অভিজ্ঞতার সমন্বয় আছে। আমরা বিশ্বাস করি, ব্যাংকিং মানে শুধু লেনদেন নয়, সম্পর্কের যত্ন নেওয়া। এই দর্শনই আমাদেরকে গ্রাহকের কাছে আলাদা করেছে।
বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। গত কয়েক বছরে এমটিবি কী কী ডিজিটাল উদ্ভাবন বা রূপান্তর অনুশীলন করেছে, যা আগামী দিনে গ্রাহকদের ব্যাংকিং সেবা প্রদান আরও আধুনিক ও সহজতর করবে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: ডিজিটাল ব্যাংকিং এখন আমাদের কার্যক্রমের কেন্দ্রে। আমরা সম্প্রতি চালু করেছি ‘এমটিবি নিও’, যা গ্রাহকদের হাতে তুলে দিচ্ছে স্মার্ট ও সহজ ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা—ভার্চ্যুয়াল কার্ড, ইনস্ট্যান্ট ট্রান্সফার, ডিজিটাল কেওয়াইসি, এমনকি রিয়েলটাইম অফার। এর পাশাপাশি আমাদের ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগ দেশের ডিজিটাল পেমেন্ট সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে আমরা আরও অটোমেশন, ডেটা অ্যানালিটিকস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সেবা চালু করব।
দেশের জনগোষ্ঠীকে আরও বিস্তৃতভাবে সেবা প্রদানে আপনারা নতুন কোনো অঞ্চলে বা খাতে নিজেদের কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা করছেন কি? বিশেষ করে গ্রামীণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমাদের অগ্রাধিকার এখন গ্রামীণ অর্থনীতি ও এসএমই খাত। আমরা বিশ্বাস করি, দেশের টেকসই উন্নয়ন গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই সম্ভব। এমটিবি বর্তমানে কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা প্রোডাক্ট সেগমেন্ট চালু করেছে এবং শাখা সম্প্রসারণের পাশাপাশি মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সেবা পৌঁছে দিচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্যও আমরা আলাদা প্রণোদনা, প্রশিক্ষণসহ আর্থিক সহায়তা দিচ্ছি।
একটি ব্যাংকের জন্য পুঁজি ও সম্পদের গুণগত মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পটভূমিতে ২৬ বছরে আপনাদের আর্থিক অবস্থান ও স্থিতিশীলতা কীভাবে বজায় রাখা হয়েছে?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমরা সব সময় সততা, শৃঙ্খলা ও দক্ষতা—এই তিন মূলনীতিতে পরিচালিত হয়েছি। আমাদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামো, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও গভর্ন্যান্স প্র্যাকটিসগুলো সব সময় শক্তিশালী রাখা হয়েছে। ২৬ বছরে এমটিবি মূলধন পর্যাপ্ততা, সম্পদের গুণগত মান ও মুনাফার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। আমরা স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়ে টেকসই লাভজনকতার পথে এগোচ্ছি।
নারীবান্ধব ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিচালন পদ্ধতি, করপোরেট সংস্কৃতি ও পরিষেবা সম্পর্কে জানতে চাই।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: এমটিবি বিশ্বাস করে, অন্তর্ভুক্তি ও সমতা ছাড়া সত্যিকারের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই বিশ্বাসের কারণে আমরা টানা চতুর্থবার ‘ইউরোমানি’র ‘বেস্ট ব্যাংক ফর ডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন ইন বাংলাদেশ’ স্বীকৃতি অর্জন করেছি।
আমাদের মোট কর্মীর প্রায় ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ ও নির্বাহী পর্যায়ে ১৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ নারী কর্মী, যাঁরা প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করছেন। পরিচালনা পর্ষদে নারী পরিচালক রয়েছেন ২৫ শতাংশ, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের তুলনায় অনেক এগিয়ে।
২০২৪ সালে চালু হওয়া ‘শ্রেয়া’ প্ল্যাটফর্ম আমাদের নারী কর্মকর্তাদের পেশাগত দক্ষতা, নেতৃত্ব ও কর্মক্ষেত্রের সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়তা করছে। অন্যদিকে ‘স্বনির্ভর অঙ্গনা’ প্রকল্প নারী উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন বিক্রয় ও আর্থিক স্বাক্ষরতায় দক্ষ করে তুলছে।
আমরা চাই, নারীরা শুধু গ্রাহক নয়, ব্যাংকিং ব্যবস্থার নেতৃত্বেও থাকুক। এই অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি, বৈচিত্র্যময় দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক নেতৃত্বই এমটিবিকে আলাদা করে।
উন্নয়নশীল দেশে একটি ব্যাংকের শুধু ব্যবসায়িক সমৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। এমটিবি সম্প্রতি কোন সামাজিক প্রকল্প বা পরিবেশ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা সামাজিক দায়বদ্ধতা পূরণে ভূমিকা রেখেছে?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমরা সব সময় বিশ্বাস করি, একটা ব্যাংকের সাফল্য শুধু লাভে নয়, সমাজে তার অবদানে। এমটিবি ফাউন্ডেশন ও ব্যাংকের নিজস্ব সিএসআর উদ্যোগ—দুটিই আজ এমটিবির সামাজিক দায়বদ্ধতার মেরুদণ্ড।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীবিকা উন্নয়নে আমরা নিয়মিত কাজ করছি। সম্প্রতি চাঁদপুরের জেলেপাড়ায় বিকল্প জীবিকা সহায়তা, বরগুনা ও চর আলেকজান্ডারে নিরাপদ পানি প্রকল্প, আর বান্দরবানে স্যানিটেশন–সুবিধা চালু করেছি।
সবচেয়ে বড় উদ্যোগগুলোর একটি হলো ‘এমটিবি–ইউসেপ স্কিলস ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (এমইউএসটিআই)’, যা ময়মনসিংহে স্থাপিত হচ্ছে। এখানে তিন বছরে ১ হাজার ২০০ সুবিধাবঞ্চিত তরুণ–তরুণীকে বাজার উপযোগী প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে—বিদ্যুৎ, সেলাই, বিউটিফিকেশন, বেকারি ও গ্রাফিক ডিজাইনে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।
আমরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য স্যামসন এইচ চৌধুরী, সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও নিলুফার মঞ্জুর স্মারক বৃত্তি চালু করেছি। নারীদের জন্য রয়েছে ‘এমটিবি স্বনির্ভর অঙ্গনা’, শিশু–কিশোরদের জন্য ‘স্বপ্ন সারথি’, আর সাহসী নাগরিকদের সম্মান জানাতে ‘এমটিবি ব্রেভারি অ্যান্ড কারেজ অ্যাওয়ার্ড’।
পরিবেশ সচেতনতায় আমরা নিয়মিত আয়োজন করছি বৃক্ষরোপণ, প্লাস্টিক–ফ্রি ক্যাম্পাস, পরিবেশ অলিম্পিয়াড ও ‘শেরপুর ১০কে রান’। এসব উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে এমটিবি পেয়েছে ‘মোস্ট ইনোভেটিভ সিএসআর ইনিশিয়েটিভস ২০২৪’ ইউরোমানির ‘হাইলি রিগার্ডেড ইন সিএসআর’ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘টপ টেন সাসটেইনেবল ব্যাংক’ সম্মাননা।
আন্তর্জাতিক অর্থবাজার ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এদিক থেকে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক কী ধরনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করছে?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমরা ঝুঁকিকে ভয় না পেয়ে তা বোঝার চেষ্টা করি। এমটিবি একটি প্রো–অ্যাকটিভ রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কাঠামো অনুসরণ করে, যা বাজার ঝুঁকি, ঋণের ঝুঁকি ও অপারেশনাল ঝুঁকিকে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করে। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার সময়েও আমরা আমাদের বিদেশি মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, লিকুইডিটি বাফার ও ডাইভারসিফায়েড ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা বজায় রাখছি।
একটি ব্যাংকের সাফল্যে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন কর্মীরা। আপনারা কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কী ধরনের প্রশিক্ষণ বা উদ্যোগ নিয়েছেন?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: এমটিবিতে আমরা কর্মীদের বলি ‘এমটিবিয়ান’। কারণ, তাঁরা শুধু কর্মী নন, আমাদের পরিবারের অংশ। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে আমরা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ট্রেনিং, মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম ও ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্ম চালু করেছি। কর্মীদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, নেতৃত্ব ও পারফরম্যান্সকে স্বীকৃতি দিতে নিয়মিত পুরস্কার ও প্রণোদনা দিই। আমরা বিশ্বাস করি, দক্ষ কর্মীই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
আগামী এক দশকে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংককে আপনি কোথায় দেখতে চান?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমাদের স্বপ্ন এমটিবিকে একটি স্মার্ট, টেকসই ও ডিজিটালি ইন্টিগ্রেটেড ব্যাংক হিসেবে গড়ে তোলা, যা প্রযুক্তি, গ্রাহক অভিজ্ঞতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার সুষম সমন্বয় ঘটাবে। আগামী দশকে আমরা চাই, ব্যাংকিং শুধু শহরে নয়, দেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে যাক, যেখানে প্রতিটি গ্রাহক তাঁর স্বপ্নপূরণের অংশীদার হিসেবে এমটিবিকে দেখবেন।
২৭ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেশের তরুণ উদ্যোক্তা, নতুন ব্যাংকিং পেশাজীবী ও গ্রাহকদের উদ্দেশে কী বলতে চান?
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: তরুণদের বলব, নিজের ওপর আস্থা রাখুন, ছোট পদক্ষেপই বড় যাত্রার সূচনা। ব্যাংকিং পেশাজীবীদের বলব, সততা ও পেশাদারত্বই সাফল্যের মূল। আর গ্রাহকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলব, আপনাদের বিশ্বাসই আমাদের শক্তি। এই ২৬ বছরের যাত্রা আপনাদের ভালোবাসাতেই সম্ভব হয়েছে এবং আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই আস্থা ও প্রগতি অব্যাহত রাখতে—ইউ ক্যান ব্যাংক অন আস।
ধন্যবাদ।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।