আমার করোনাকালীন পোষ্য ‘পিন্টু’ 

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

শৈশবে আমাদের বাসায় আমরা পরপর দুটি কুকুর এবং একাধিক বিড়াল আর বিড়ালছানার সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। আমাদের বাড়ির সামনে এবং পেছনে কিছুটা খালি জায়গা থাকায় কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে অনেক ভালো সময় কাটাতে পারতাম। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে ঢাকা শহরের অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা হয়ে সে শৌখিনতা আর সম্ভব ছিল না। স্কয়ার ফুট হিসাব করা অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর কুকুর-বিড়ালসহ থাকাটা বাদ পড়ে যায়। বরং মশা-মাছির সঙ্গে বাস করাটা আমাদের জন্য মোটামুটি বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়।

২০২০ সালে করোনার সময় আমরা ধানমন্ডি লেকসংলগ্ন বিল্ডিংয়ের তিনতলার একটি অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা ছিলাম। লেকের একেবারে কাছাকাছি হওয়ায় দিনরাত সারাক্ষণই আমাদের মশার দংশন আস্বাদ করতে হতো। মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে কড়া গন্ধযুক্ত কয়েল আর ব্যাটারিচালিত র‌্যাকেট সবার হাতে হাতে সন্ধ্যা থেকে সক্রিয় থাকত। তবে আমি কয়েল কিংবা মশা মারার র‌্যাকেট কোনোটাই ব্যবহার করি না। এর বিকল্প হিসেবে বহুদিন থেকে আমার ঘরের সব দরজা বন্ধ করে রাখার অভ্যাস করে ফেলেছি। আর যখন যেখানে থেকেছি, জানালায় নেট লাগানোর ব্যবস্থা করে নিতাম। তবে এত সব ব্যবস্থার পরও দরজা বন্ধ ও খোলার ফাঁকে মশা ঘরে ঢুকে যেত। যখনই কোথাও বসতাম, তখনই তারা দংশনের জন্য একটুও সময় ব্যয় না করে শরীরের যেসব অংশ অনাবৃত থাকত, সেখানেই মহানন্দে হুল ফোটাত। আমিও আমার দুই হাত দিয়ে অনবরত তাদের নিধনযজ্ঞ চালাতে থাকতাম। পরে মেঝেতে কোথাও জমা করে ঝুড়িতে ফেলতাম। করোনার সময় যেহেতু বাড়িতেই সময় কাটাতে হতো, তাই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে করোনা নিয়ে সাম্প্রতিক তথ্য দেখার সময় অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

কয়েক দিন পর হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমি মশাগুলো মেঝেতে ফেলার পরপরই অদৃশ্য হয়ে যায়! আরে, এটা কীভাবে সম্ভব? কারণ, মেঝেতে রাখার সময় এটা নিশ্চিত করতাম যে এগুলো যেন আর উড়তে না পারে। একটু ভালোভাবে খেয়াল করে দেখি, আমি মাটিতে ফেলার পরপরই সেখানে সোফার নিচ থেকে একটা টিকটিকি এসে সেটা টুপ করে মুখে নিয়ে আবার ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করে। প্রতি সন্ধ্যায় এটা আমার জন্য একটা ঔৎসুক্যের ব্যাপার হয়ে ওঠে। আমি দ্বিগুণ উৎসাহে মশার নিধনকর্ম অব্যাহত রেখে ওর খাদ্যের জোগান দিতে থাকতাম। ওই সময় আমার ছোট বোনেরও কর্মক্ষেত্রে যাওয়া সাময়িক বন্ধ থাকায় কিছুদিন আমার বাসায় এসে থাকছিল। সে পুরো ব্যাপারটা দেখে খুব মজা পেয়ে বলল, ‘ও যেহেতু আমাদের দৈনন্দিন সঙ্গী হয়ে গেছে, আমরা ওর একটা নাম রাখি।’ কী নাম রাখা যায় এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে সে-ই নাম দিল ‘পিন্টু’। সেদিন থেকে আমরা দুই বোন টিভি দেখার ফাঁকে ফাঁকে পিন্টুর খাবার জোগান দিতাম আর ওর তৃপ্তি করে খাওয়া দেখে ভীষণ আনন্দ পেতাম। একদিন টিভি দেখতে দেখতে আমার পায়ে হঠাৎ একটা খোঁচা লাগতেই চমকে দেখি পিন্টু আমার পায়ে বসা একটা মশা টুপ করে মুখে নিয়ে পালাল। মনে হলো তত দিনে ও এই অধিকারটা অর্জন করে ফেলেছে। ওর এই অধিকারের পরবর্তী ধাপে ও আমার সোফায় আসীন হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে সোফার নিচ থেকে মাথাটা বের করে দু-তিনবার ‘টিক টিক’ করে নিজের উপস্থিতিটা জানান দিত।

যখন করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে এল, তখন কাজের প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় কিছু সময়ের জন্য বের হতাম। সে সময় টেলিভিশনের সামনে যখন বানু, আমার চার দশকের অধিক সময়ের সংসার পরিচালিকা বসত, ওর কাছেও নাকি একইভাবে খাবারের জন্য ইঙ্গিত করত। বেশ কয়েক মাস ধরেই পিন্টু আর আমাদের এই একত্র বসবাস চলছিল।

করোনার শেষের দিকে বিশেষ কারণে আমাকে হঠাৎ এই অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়তে হলো। যখন আমরা জিনিসপত্র গোছগাছ করছিলাম, তখন পর্যন্ত সময়মতোই পিন্টুর উপস্থিতি থাকত। বাসাবদলের কাজ শুরু হলে প্রথমত শোবার ঘর, বসার ঘরের জিনিসপত্র গোছগাছের সময় ও খুব পিটপিট করে আশপাশে দেখে আবার সোফার নিচে ঢুকত। ফাঁকা ঘর দেখে ঘোরাঘুরি করতে ওর কিছুটা দ্বিধা কাজ করত। যেদিন একেবারে সব গুটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, আমি সব ঘরে ঢুকে বারকয়েক ডেকে আর ওর দেখা পেলাম না।

ভারাক্রান্ত মনে শেষবারের মতো এই আশা, প্রার্থনাসহ বের হলাম যে পিন্টু যেখানেই থাকুক নিশ্চয়ই ভালো আছে, ভালো থাকবে। আমার জীবদ্দশায় কুকুর, বিড়াল, পাখি বাড়িতে পোষার পর টিকটিকির মতো প্রাণীও যে পোষ মানে, মানতে পারে, আমার সেই অভিজ্ঞতাটা সঞ্চিত হলো। করোনা থেকে আমাদের অর্জনও খুব কম নয়।