নিরাপদ প্রসব, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের মতো বিষয়ে সরকারি ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করলে এ ক্ষেত্রে আরও সাফল্য আসবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে এটা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তাঁরা।
রাজধানীতে মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে আজ মঙ্গলবার ‘পার্টনারিং টুয়ার্ডস ইন্টিগ্রেটেড রুরাল হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এই অভিমত দেন।
বেসরকারি সংস্থা লুথারেন্ড এইড মেডিসিন ফর বাংলাদেশ (ল্যাম্ব) এই সেমিনারের আয়োজন করে। ল্যাম্ব দেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছে। সেমিনারে সরকারি প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘের সংস্থা, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ল্যাম্বের নির্বাহী পরিচালক ডেভিড চন্দ্রন শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, সরকারি স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি জাতিসংঘের সংস্থা, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠী জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা রয়েছে। সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করার একটি তাগিদ থেকে এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।
ল্যাম্বের স্বাস্থ্য ও আর্থসামাজিক বিষয়ক প্রশিক্ষক স্টেসি সাহা সেমিনারের মূল বক্তব্য ও ল্যাম্বের বিস্তারিত কার্যক্রমের উপস্থাপনা তুলে ধরেন।
এতে জানানো হয়, ল্যাম্ব জনস্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মানসিক স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল পরিচালনার মতো শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় তাদের একটি এক শ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। এখানে বিনা মূল্যে এবং নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জনগণের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। তবে সীমাবদ্ধতাও আছে। তা সত্ত্বেও কীভাবে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। নিরাপদ প্রসব, মানসিক স্বাস্থ্যসহ জনস্বাস্থ্যের অনেক বিষয়েই সরকারে একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। সে কারণে যারা এসব ক্ষেত্রে কাজ করছে, সরকার সেই সব উন্নয়ন সহযোগীদের স্বাগত জানায়। তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমন্বিতভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশ প্রতিনিধি ক্রিস্টিন ব্লুখোস বলেন, বাংলাদেশে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার জন্য সরকার স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ল্যাম্বের মতো অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রসবকালীন ফিস্টুলা নির্মূলের বিষয়ে তারা খুবই ভালো কাজ করেছে। ইউএনএফপিএ তাদের সঙ্গে আরও ব্যাপক পরিসরে কাজ করতে চায়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ফুড ফর হাংরি বাংলাদেশের পরিচালক সমরেশ নায়ক বলেন, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো এককভাবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। এককভাবে কাজ করার সময় সংস্থাগুলোর মধ্যে পরস্পরের প্রতি প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থাকে। তবে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত উদ্যোগের ভিত্তিতে কাজ করলে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হয়ে যায়। তাতে উন্নয়নও টেকসই হয়ে ওঠে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে টিয়ারফান্ড বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি প্রণয় ছেত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ, নেপাল, ভারতসহ উপমহাদেশের সবগুলো দেশেই লিঙ্গবৈষম্য, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রায় একই রকম। আমরা সমন্বিতভাবে আয়বর্ধক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এসব সমস্যার সমাধানে কাজ করে যেতে চাই।’
অনুষ্ঠানে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের উপপরিচালক রাহুল ম্যাথুর সঞ্চালনায় কর্মঅধিবেশনে বেসরকারি সংস্থা জাপাইগোর বাংলাদেশ প্রধান সিতারা রহমান, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের তীর্থ সারথি শিকদার, ওয়ার্ল্ড ভিশনের পরিচালক চন্দন জেড গমেজ, ল্যাম্বের মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আন্না পটকাম ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মলয় কান্তি মৃধা বক্তব্য দেন।
তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে আধুনিক ভাবনায় স্বাস্থ্য কেবল শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, তিনটি বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত। শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য এবং আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য। এই তিনটি বিষয়ের সঠিক পরিচর্যার প্রয়োজন। পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য এই তিনটি ক্ষেত্রেই সুস্থতার প্রয়োজন। এসব কারণে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কাজের জন্য একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। নারীদের নিরাপদ প্রসবের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ, পুষ্টির অভাব, গৃহে প্রসবকালে প্রশিক্ষিত ধাত্রী না থাকার মতো সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বাল্যবিবাহ, পুষ্টির অভাব, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে দারিদ্র্য, কিশোরীদের ক্ষেত্রে প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা না থাকা, তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ গড়া নিয়ে মানসিক চাপ, এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত। এসব নিয়ে অনেক কাজ করার আছে।
সবশেষে অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানান ল্যাম্বের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য লেবিও বালা।