ঢাকার পেট্রলপাম্পগুলোতে তেল ফুরিয়ে আসছে, অনেকগুলো বন্ধ

জ্বালানি তেল
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

দেশে ডিপো (মজুতাগার) থেকে পাম্পে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকে। এর মধ্যেই আজ রোববার থেকে শুরু হয়েছে পেট্রলপাম্প মালিকদের একাংশের ধর্মঘট। ধর্মঘটের ঘোষণা জেনে গতকাল শনিবার অনেকেই পেট্রলপাম্পে ভিড় করে বেশি করে তেল কিনেছেন। আবার আন্দোলন কর্মীদের ঘেরাওয়ের কারণে দেশের বিভিন্ন ডিপো থেকে আজও তেল নিতে পারেননি পেট্রলপাম্প মালিকেরা। এতে পেট্রলপাম্পে তেলসংকট দেখা দিয়েছে।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রলপাম্প থেকে ডিজেল, পেট্রল, অকটেনের মতো জ্বালানি তেল সরবরাহ কমে গেছে। পাম্পের নিজস্ব মজুত থেকে বিক্রি করছে তারা। বেশির ভাগ পাম্পের মজুত ফুরিয়ে গেছে। এ কারণে পাম্প বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

রাজধানীতে রাত পৌনে আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত ছয়টি পেট্রল পাম্প ঘুরে দেখা যায়, পাঁচটি পুরোপুরি বন্ধ। অনেকেই তেল নিতে এসে ফিরে যাচ্ছেন।

কল্যাণপুরের সাহিল ফিলিং স্টেশন দুপুরের পর থেকে তেল দিতে পারেনি। একই এলাকার সোহরাব সার্ভিস স্টেশনে গতকাল শনিবার রাতেই তেল শেষ হয়ে যায়। অন্যতম বড় ফিলিং স্টেশন খালেক সার্ভিস স্টেশন আজ বিকেল থেকে তেল দিতে পারছে না। আর কল্যাণপুরের কমফোর্ট ফিলিং স্টেশন সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে ‘তেল নাই’ লিখে। ঢাকার অন্যতম বড় পাম্প আসাদগেটের তালুকদার ফিলিংও বন্ধ দেখা যায়। পাঁচটি পেট্রল পাম্পের কর্মীরা জানান, তাঁরা আজ ডিপো থেকে তেল আনতে পারেননি। তাই মজুত শেষ।

তবে আসাদগেটের সোনার বাংলা ফিলিং স্টেশনে রাত আটটার দিকে তেল বিক্রি করতে দেখা যায়। সেখানে ছিল লম্বা লাইন।

এদিকে দাবি পূরণ না হওয়ায় ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে পেট্রলপাম্প মালিকদের একাংশ। তবে তাদের এই ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে মালিকদের আরেক অংশ।

তিন দফা দাবি পূরণে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল পেট্রলপাম্প মালিক সমিতির একটি অংশ। এর মধ্যে একটি দাবি পূরণ করা হয়েছে। তবে তাদের মূল দাবি, জ্বালানি তেলে কমিশন বাড়ানো। ২০১৬ সাল থেকে এ দাবি জানিয়ে আসছে তারা। নতুন করে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। একটি অংশ তা মেনে নিলেও আরেকটি অংশ তা না মেনে ধর্মঘট শুরু করে।

আন্দোলনরত মালিক সমিতির মহাসচিব মিজানুর রহমান আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আলোচনার জন্য ডাকা হয়নি। তাই জ্বালানি তেল উত্তোলন বন্ধ থাকবে। সোমবার থেকেই অনেক পাম্প থেকে তেল সরবরাহ বন্ধ হতে পারে। পরদিন বেশির ভাগ পাম্প তেল দিতে পারবে না। পেট্রলপাম্প থেকে গ্রাহক তেল না পেলে তার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে।’ ডিপো থেকে জ্বালানি তেল সরবরাহে আন্দোলনকারীরা বাধা দিচ্ছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, মালিকদের সঙ্গে বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকেরাও যুক্ত হয়েছেন। তাঁরা ডিপো ঘেরাও করে রেখেছেন। কেউ তেল বের করতে পারবে না। শুধু জরুরি বিবেচনায় উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল পরিবহন বিকেলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

মালিকদের অভিযোগ, ২০১৬ সালের মার্চে সরকারের সঙ্গে বৈঠকে ১২ দফা দাবি জানান পেট্রলপাম্প মালিকেরা। তাৎক্ষণিকভাবে তিনটা মেনে নেওয়া হয়। এরপর আরও কয়েকটা মেনে নিয়েছে। পাঁচটা দাবি বাকি রয়ে যায়। এর মধ্যে অন্যতম কমিশন বাড়ানো। কিন্তু এটি নিয়ে বারবার সময় পিছিয়েছে সরকার। কমিশন বাড়াতে চায় না জ্বালানি তেল সরবরাহকারী সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। প্রতি লিটারে নির্ধারিত কমিশন পায় তারা। ডিজেলে দুই টাকার কিছু বেশি আর পেট্রল ও অকটেনে তিন থেকে চার টাকা কমিশন পায় তারা। এটি তেলের দামের সাড়ে ৭ শতাংশ করার দাবি তাঁদের। এটি নিয়ে সমঝোতা করে কিছুটা কমাতেও রাজি আছেন তাঁরা। তবে সরকার একটি পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় নিলেও আন্দোলনকারী পক্ষের সঙ্গে কোনো বৈঠক হয়নি।

তবে আজ সংবাদ সম্মেলন করে এ ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে নিবন্ধিত সংগঠন পেট্রলপাম্প মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক। তিনি বলেন, গ্রাহকদের ভোগান্তিতে ফেলতে একটি অংশ ধর্মঘট করছে। তারা সমিতির কেউ না। মালিকদের বড় অংশ ওদের সঙ্গে নেই। কিন্তু বাধার মুখে ডিপো থেকে তেল নিতে পারছেন না মালিকেরা। এতে করে পেট্রলপাম্পে তেল সরবরাহ কমে গেছে। তিনি বলেন, যেহেতু সরকার ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাবি মানার আশ্বাস দিয়েছে, তাই এখন আন্দোলন করার যুক্তি নেই।

সরকার অনুমোদিত পরিবেশকদের নিয়মিত জ্বালানি তেল সরবরাহ করে বিপিসির অধীন থাকা তিন রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। এ জ্বালানি তেল কিনে নিয়ে পরিবেশকেরা নিজস্ব পেট্রলপাম্প থেকে ডিজেল, পেট্রল ও অকটেন বিক্রি করে গ্রাহকের কাছে।

আজ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি পেট্রলপাম্প ঘুরে জ্বালানি তেল না থাকার চিত্র দেখা গেছে। এর মধ্যে তেজগাঁও এলাকার বড় পেট্রলপাম্প সাউদার্ন আজ অকটেন সরবরাহ করতে পারেনি। এখানকার এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সকালে কিছু পেট্রল দিতে পেরেছেন। বিকেলে শুধু ডিজেল ছিল তাঁদের কাছে। গতকাল শনিবার রাত আড়াইটা পর্যন্ত ভিড় ছিল তাঁদের পাম্পে। আজ তাঁদের পাম্পে ডিপো থেকে তেল আসেনি।

ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য অকটেন নিতে আজ ঢাকার চারটি পেট্রলপাম্পে ঘুরেছেন একজন গণমাধ্যমকর্মী। তিনি বলেন, তিনটিতে কোনো পেট্রল পাওয়া যায়নি। একটি পাম্প থেকে মাত্র ১০ লিটার নিতে পেরেছেন। বেসরকারি একটি সংস্থায় কর্মরত আসিফ রহমান আজ সকালে তিনটি পেট্রলপাম্প ঘুরে তেল কিনতে পারেননি।

এ বিষয়ে বিপিসির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া আজ সাংবাদিকদের বলেন, দাবি কিছু মানা হয়েছে, বাকিটা প্রক্রিয়াধীন। এর মধ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া অযৌক্তিক। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সোমবার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাম্পে জ্বালানি তেল সরবরাহ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা। পাম্পগুলো মজুত থেকে তেল দিচ্ছে। যদিও খুলনায় ধর্মঘটের কথা শুনে বেশি করে তেল কেনায় মজুত শেষ হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। খুলনা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, খুলনা নগরের পাওয়ার হাউস মোড় এলাকায় আজ বেলা আড়াইটার দিকে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য তেল নিতে এসেছিলেন সোহেল আহমেদ। এসে দেখেন পাম্পে পেট্রল ও অকটেনের লাইনের সামনে ঝুলছে ‘তেল নেই’ লেখা কাগজ। ওই পেট্রলপাম্পের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ধর্মঘটের কথা শুনে মানুষ যানবাহনে বেশি করে তেল নিয়ে রেখেছেন। গতকাল শনিবার সারা রাতই তেল নিতে ব্যাপক ভিড় ছিল পাম্পে। সকালের দিকে পেট্রল ও অকটেন ফুরিয়ে যায়; কিন্তু ডিজেল এখনো আছে। আরও কয়েকটি পাম্প ঘুরে প্রায় একই পরিস্থিতি দেখা গেল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, ‘এভাবে ভোক্তাদের জিম্মি করে কমিশন বাড়ানোর চাপ দিতে পারেন না পেট্রলপাম্প মালিকেরা। বিদ্যমান কমিশনে তেল বিক্রি করতে রাজি না হলে তাঁদের লাইসেন্স বাতিল করা হোক। এরপর উন্মুক্ত আহ্বানের মাধ্যমে নতুন করে লাইসেন্সের আবেদন নিয়ে পেট্রলপাম্প চালু করতে পারে সরকার।’

আরও পড়ুন