বাংলাদেশসহ ৭ দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্র

১৩ কারণে বিশ্বে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে সহায়তার উদ্যোগ।

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশাছবি: রয়টার্স

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২৩ সালে সাতটি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্রতর হয়েছে। তালিকার শুরুতে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। সংস্থাটি বলছে, ১৩টি কারণে সারা বিশ্বে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার ‘ডেঙ্গু: বৈশ্বিক পরিস্থিতি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই তথ্য দিয়েছে। প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে, গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে দেখা গেছে। ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৫ লাখ মানুষ, ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৫২ লাখ। অর্থাৎ আক্রান্তের সংখ্যা ১০ গুণ বেড়েছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সার্বিকভাবে সহায়তার কথা বলেছে। সেসব মেনে কাজ করলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক বছর লেগে যাবে। আমাদের এখন দরকার ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমানো।
মুশতাক হোসেন, জনস্বাস্থ্যবিদ

সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ছাড়াও ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্রতর হওয়া দেশগুলোর তালিকায় আছে ব্রাজিল, বুরকিনা ফাসো, ফিজি, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। বলা হয়েছে, কোনো কোনো দেশে ডেঙ্গু জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৩টি কারণে বিশ্বে ডেঙ্গু বাড়ছে। কারণগুলো হচ্ছে এডিস ইজিপটাই মশা ছড়িয়ে পড়ছে ও পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও মশার বসবাসের উপযোগী অন্যান্য কর্মকাণ্ড বাড়ছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর উপযোগী আবহাওয়া, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকা ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, একই সঙ্গে ডেঙ্গুর একাধিক ধরনের বিস্তার, সুনির্দিষ্ট লক্ষণ না থাকায় ডেঙ্গু শনাক্ত করার সমস্যা, ল্যাবরেটরি ও পরীক্ষাব্যবস্থার অপ্রতুলতা, কোভিড–১৯–সহ একই সময়ে দীর্ঘস্থায়ীভাবে চলা প্রাদুর্ভাব, ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার অনুপস্থিতি, ডেঙ্গু সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা ও আচরণ বিষয়ে তথ্য–উপাত্তের ঘাটতি, কমিউনিটিকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডের ঘাটতি, মশার ওপর নজরদারি ও মশা নিয়ন্ত্রণ দক্ষতার ঘাটতি, স্থায়ীভাবে অর্থায়নের ঘাটতিসহ অংশীজনদের কাজে সমন্বয়ের অভাব এবং মানুষ ও পণ্যের ব্যাপক চলাচল।

আরও পড়ুন

জাতিসংঘের এই বিশেষায়িত সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, কোভিড–১৯ মহামারি এবং ওই সময় তথ্য–উপাত্তের কমতির কারণে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমতে দেখা যায়। কিন্তু ২০২৩ সালে বৈশ্বিকভাবে তা আবার বাড়তে দেখা গেছে। এই বৃদ্ধি শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয়। কোথাও কোথাও একাধিকবার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এমনকি আগে ছিল না এমন অঞ্চলেও ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেকটা ঘুরে ঘুরে আসে এবং প্রতি তিন–চার বছর পরপর বড় প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে উল্লেখযোগ্যভাবে ডেঙ্গু বেড়েছে। বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে আক্রান্ত ছিল ৬২ হাজার ৩৮২ জন। আর ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত ছিল ৩ লাখ ৮ হাজার ১৬৭ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে সংক্রমণ বেড়েছে যথাক্রমে প্রায় ৪৯৪ ও ২৯৩ শতাংশ।

একই সময়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর এ বছর মৃত্যু ও মৃত্যুহার দুই–ই বেড়েছে। নভেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৫৯৮ জনের মৃত্যু হয়। তখন মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ।

ডেঙ্গু সংক্রমণের সময় ও স্থানে কিছু পরিবর্তনের বিষয় উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশ ও নেপালে ডেঙ্গুর সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ (পিক বা শীর্ষ) গত বছরের চেয়ে এবার আগেভাগে দেখা গেছে। ২০২২ সালে কাঠমান্ডু উপত্যকায় সংক্রমণ বেশি ছিল। এ বছর নেপালে সংক্রমণ বেশি হয়েছে দক্ষিণ–পূর্ব তরাই অঞ্চল ও গান্দাকি প্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে। অন্যদিকে ভারতে এবার সংক্রমণ বেশি হয়েছে কেরালা রাজ্যে ও বাংলাদেশসংলগ্ন উত্তর–পূর্ব প্রদেশগুলোতে।

পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৯টি উদ্যোগ নিচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর মধ্যে আছে কাজের সমন্বয়, প্রস্তুতি ও কর্মোদ্যোগ, বহু খাতভিত্তিক সহযোগিতা, মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, ল্যাবরেটরি স্থাপন, সরঞ্জাম সরবরাহ, রোগী ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, রোগতাত্ত্বিক নজরদারি এবং ঝুঁকি যোগাযোগ ও জনসম্পৃক্ততা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই মূল্যায়ন সম্পর্কে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সার্বিকভাবে সহায়তার কথা বলেছে। সেসব মেনে কাজ করলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক বছর লেগে যাবে। আমাদের এখন দরকার ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমানো। এ জন্য চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরি।’

সর্বশেষ পরিস্থিতি

গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) সারা দেশে ১০৪ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কোনো মৃত্যু হয়নি।

এ বছর এই পর্যন্ত সারা দেশে ৩ লাখ ২০ হাজার ১৫৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৬৯২ জন। এ বছর বিশ্বের কোনো দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এত মৃত্যু হয়নি। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এ বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ব্রাজিলে। দেশটিতে সন্দেহভাজন আক্রান্তের সংখ্যা ২৯ লাখ ৯ হাজার ৪০৪।