সুলভে গরুর মাংস বিক্রির নামে আরেক ‘বাণিজ্য’

  • সুলভ মূল্যে বিক্রির জন্য সরকারি খামার থেকে ৪৪৮টি গরু দেওয়া হয়েছে কম দামে।

  • বাজারে প্রভাব নেই। উল্টো দাম বাড়ছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র থেকে মাংস, ডিম, দুধ কিনছেন মানুষফাইল ছবি: প্রথম আলো

পবিত্র রমজান মাসে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগে রাজধানীতে ‘সুলভ মূল্যে’ গরুর মাংস বিক্রি করা হচ্ছে। তবে অনুসন্ধান চালিয়ে এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুলভে বিক্রির নামে করা হচ্ছে ‘আরেক বাণিজ্য’।

কম দামে বিক্রির জন্য সরকারি খামার থেকে ৪৪৮টি গরু সরবরাহ করা হয়েছে। খামার মালিক সমিতিও গরু দিচ্ছে। সরকারি খামারের গরু ও খামারমালিকদের সরবরাহ করা গরুর মাংসের দাম (কেজি ৬০০ টাকা ধরে) হিসাব করে দেখা যায়, প্রতি কেজি মাংসের গড় ব্যয় দাঁড়ায় ৫২৮ টাকা।

যদিও রাজধানীতে সুলভ মূল্যে গরুর মাংস বিক্রি করা হচ্ছে ৬০০ ও ৬৫০ টাকা কেজিতে। উল্লেখ্য, মাংস বিক্রির সব খরচ সরকার দিচ্ছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক এবং খামারমালিকদের সমিতি বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি ইমরান হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, সুলভে গরুর মাংস বিক্রিতে মুনাফা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই; বরং লোকসান হচ্ছে।

রেয়াজুল হক আরও দাবি করেন, জনস্বার্থের কথা চিন্তা করে খামার মালিক সমিতি মাংস বিক্রি চলমান রেখেছে। সংগঠনটির সভাপতি ইমরান হোসেনকে প্রতিদিনই অনুরোধ করতে হচ্ছে, যাতে তিনি কার্যক্রমটি চলমান রাখেন।

আরও পড়ুন

অবশ্য পাঁচ দিনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও সরকারি খামারের কর্মকর্তা এবং ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের কাছে একাধিক দফা গিয়ে সরকারি খামারের বাইরে কার কার কাছ থেকে গরু নেওয়া হচ্ছে, কত দামে নেওয়া হচ্ছে, ওজন কত—সেসবের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি; বরং প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসব তথ্য লুকিয়ে রাখার চেষ্টা দেখা গেছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, খামার মালিক সমিতির নেতারা সুলভে বিক্রির আয়োজন করে নিজেদের ‘ক্রেডিট’ (সুনাম) বাড়াচ্ছেন। মাংস বিক্রিতে মুনাফাও হচ্ছে। শুধু গরুর মাংস বিক্রিতে এক মাসে এক কোটি টাকার বেশি।

সুলভ মূল্যে সামান্য কিছু মাংস বিক্রি করে বাজারে সুনাম কামানোর বিপরীতে বাজারে দাম শুধু বাড়ানোই হচ্ছে উল্লেখ করে ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, খামার মালিক সমিতির নেতারা দেশে মাংসের দাম কমবে, এমন কোনো ব্যবস্থাপনামূলক উদ্যোগ নিতে বাধা হয়ে দাঁড়ান। প্রাণিসম্পদ খাতে সরকারের অনুদান, ঋণসহ বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধাভোগীর তালিকা করতেও তাঁরা প্রভাব বিস্তার করেন।

সরকারি খামারের গরু ও খামারমালিকদের সরবরাহ করা গরুর মাংসের দাম (কেজি ৬০০ টাকা ধরে) হিসাব করে দেখা যায়, প্রতি কেজি মাংসের গড় ব্যয় দাঁড়ায় ৫২৮ টাকা। যদিও রাজধানীতে সুলভ মূল্যে গরুর মাংস বিক্রি করা হচ্ছে ৬০০ ও ৬৫০ টাকা কেজিতে।

সুলভে বিক্রি ‘লাভজনক’

পবিত্র রমজান মাসে মাংস, ডিম, দুধ ও মুরগি সরবরাহের জোগান ও মূল্য স্থিতিশীল রাখতে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্র পরিচালনার বিষয়ে ৪ মার্চ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে একটি সভা হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রাজধানীর ৩০টি স্থানে প্রাণিজ পণ্য বিক্রি করা হবে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ গরুর মাংস সরবরাহ করবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। আর বাকি ৫০ শতাংশ সরবরাহ করবে বিডিএফএ।

ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০০ টাকা। স্থায়ী বাজারে নির্ধারিত পাঁচটি দোকানের জন্য গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করা হয় ৬৫০ টাকা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, রাজধানীর বাজারে গরুর মাংসের মূল্য প্রতি কেজি ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা।

সুলভে মাংস বিক্রির জন্য গরু সংগ্রহ করা হচ্ছে দুভাবে—সরকারি খামার থেকে এবং খামার মালিক সমিতির নিজস্ব উদ্যোগে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, সুলভে বিক্রির জন্য সাতটি সরকারি খামার থেকে ৪৪৮টি গরু বিক্রি করা হয়েছে খামার মালিক সমিতির কাছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, খামার মালিক সমিতির নেতারা সুলভে বিক্রির আয়োজন করে নিজেদের ‘ক্রেডিট’ (সুনাম) বাড়াচ্ছেন। মাংস বিক্রিতে মুনাফাও হচ্ছে। শুধু গরুর মাংস বিক্রিতে এক মাসে এক কোটি টাকার বেশি।

জীবিত অবস্থায় ওজন দিয়ে সরকারি খামারের গরুগুলোর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি খামারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা বিভিন্ন দামে গরু সরবরাহ করেছে। সেগুলোর গড় দাম পড়েছে প্রতি কেজি ২৫৫ টাকা (জীবন্ত অবস্থায়)। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) রয়েছে। সেটা যোগ করা হলে জীবন্ত অবস্থায় প্রতি কেজির দাম দাঁড়ায় ২৯৩ টাকা।

সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাব ও মাংস ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটি গরুর মোট ওজনের ৫৫ শতাংশ বিক্রিযোগ্য মাংস ও হাড় পাওয়া যায়। বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মাংস ও হাড় ছাড়াও কলিজাসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মাথা, ভুঁড়ি, পা, চামড়া ইত্যাদি বিক্রি করা যায়।

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অবস্থিত সরকারি দুগ্ধ ও গবাদিপশু উন্নয়ন খামার থেকেও সুলভে বিক্রির জন্য ৭০টি গরু সরবরাহ করা হয়েছে। খামারটির উপপরিচালক মলয় কান্তি মোদক প্রথম আলোকে বলেন, জীবন্ত অবস্থায় ওজনের বিপরীতে যে ৫৫ শতাংশ মাংস ধরা হয়, সেটা শুধু হাড় ও মাংস। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্তর্ভুক্ত নয়।

হিসাব করে দেখা যায়, গরু জীবন্ত অবস্থায় মাংসের দাম যদি ২৯৩ টাকা পড়ে, তাহলে প্রতি কেজি বিক্রিযোগ্য মাংসের দাম পড়ে ৪৩০ টাকার মতো (অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দাম ধরে)। উদাহরণ হলো, সরকারি খামার থেকে বিক্রি করা গরুর গড় ওজন ২৬০ কেজি। ২৯৩ টাকা কেজি দরে জীবন্ত অবস্থায় একটি গরুর গড় দাম ৭৬ হাজার ১৮০ টাকা। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দাম পাওয়া যাবে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। ফলে মাংস ও হাড়ের দাম দাঁড়াবে ৬১ হাজার টাকার মতো। মাংস ও হাড় পাওয়া যাবে ১৪৩ কেজির মতো। এ হিসাবে মাংস ও হাড়ের দাম পড়বে প্রতি কেজি ৪৩০ টাকার কিছু কম।

খামার মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সরকারি খামার থেকে যে গরু সরবরাহ করা হয়েছে, সেগুলোর থেকে ৬১ হাজার ৬০০ কেজি মাংস পাওয়া যাবে। রোজায় সুলভ মূল্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার কেজি মাংস বিক্রি করা হবে। বাকি মাংসের জোগান দেওয়া হচ্ছে খামারিদের কাছ থেকে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলেছিল, সুলভে বিক্রির ফলে দাম স্থিতিশীল থাকবে। যদিও দিনে ৫ হাজার কেজি মাংস বিক্রির কোনো প্রভাব পড়েনি।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও বলছে, তাদের সরবরাহ করা গরুর দাম কম ধরা হয়েছে। তবে খামারমালিকদের সরবরাহ করা গরুর দাম বেশি পড়বে। দুয়ে মিলে গড় দাম বেশি দাঁড়াবে। অবশ্য খামার মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি খামার থেকে যে দামে গরু সরবরাহ করা হচ্ছে, এতে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারি খামারের গরু না নিয়ে খামারিদের কাছ থেকে গরু নেওয়া হলে তাঁর ক্ষতি কম হতো।

খামার মালিক সমিতি বলছে, সুলভে মাংস বিক্রির জন্য গরু সরবরাহে তারা কোনো মুনাফা করছে না। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, এক কেজি মাংসের উৎপাদন খরচ ৫৮৮ টাকা। খামারমালিকেরা সুলভে বিক্রির জন্য যে গরু সরবরাহ করছেন, তাতে সামান্য মুনাফা (বিক্রিযোগ্য মাংসে প্রতি কেজি ১২ টাকা) ধরা হলেও প্রতি কেজির দাম দাঁড়ায় ৬০০ টাকা। খামার মালিক সমিতি যদি ৬০০ টাকা কেজি দরে ৮৩ হাজার ৪০০ কেজি মাংস সরবরাহ করে, তাহলে সুলভে বিক্রি হওয়া মোট মাংসের গড় দাম দাঁড়াবে ৫২৮ টাকা।

রাজধানীতে সুলভে বিক্রির কার্যক্রমে গরু পরিবহন, মাংস কাটা, বিক্রি ও ফ্রিজিং (হিমায়িতকরণ সুবিধাযুক্ত) ভ্যানের ভাড়াসহ সব খরচ বহন করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। পুরো কার্যক্রমে নিয়োজিত জনবলের মজুরিও দিচ্ছে তারা।

টিসিবির হিসাবে, এক মাস আগের তুলনায় গরুর মাংসের দাম কেজিতে ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৭৮০ টাকায়।

মাংসের যৌক্তিক দাম কত

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ১৫ মার্চ ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়। তখন তিন পর্যায়ের মুনাফা ও অন্যান্য খরচ ধরে খুচরায় প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬৬৪ টাকা।

এর আগে গত ডিসেম্বরে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তৎপরতায় খামার মালিক সমিতি ও মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ঢাকায় ৬৫০ টাকা কেজিতে মাংস বিক্রি শুরু করে। যদিও তা এক মাসও স্থায়ী হয়নি।

রাজধানীর গাবতলীর গরুর হাটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে গরুর দাম দুই রকম। একটি হলো, কোরবানির গরু। এসব গরু হৃষ্টপুষ্ট এবং দেখতে আকর্ষণীয়। দাম বেশি। অন্যগুলো মাংস ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রিযোগ্য গরু নামে পরিচিত, যা ততটা আকর্ষণীয় নয়। দাম কম।

গাবতলীকেন্দ্রিক ঢাকা গবাদিপশু ব্যবসায়ী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও গরু ব্যবসায়ী আবদুল জলিল প্রথম আলোকে বলেন, চার মণ (১৬০ কেজি) মাংস পাওয়া যাবে, এমন একটি সাধারণ গরুর দাম গাবতলীর গরুর হাটে এখন ১ লাখ ১০ হাজার টাকার আশপাশে। সেখান থেকে ১৫ হাজার টাকা পাওয়া যাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দামবাবদ। ফলে ১৬০ কেজি মাংসের দাম দাঁড়াবে ৯৫ হাজার টাকা। প্রতি কেজির দাম পড়বে ৫৯৪ টাকা। গ্রাম থেকে কিনলে খরচ আরও কম হবে।

আবদুল জলিল বলেন, মাংস ব্যবসার গুমর আছে। মাংস পানিতে ভেজালে প্রতি মণে ৫ কেজি ওজন বেড়ে যায়। সারা দিন ধরে বিক্রির সময় শুকালেও তিন কেজি ওজন বাড়তি থাকে। চার মণে যদি ১২ কেজি ওজন বাড়ে, তাহলে ৮ হাজার টাকার মতো বেশি দাম পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

বাজারে প্রভাব নেই

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলেছিল, সুলভে বিক্রির ফলে দাম স্থিতিশীল থাকবে। যদিও দিনে ৫ হাজার কেজি মাংস বিক্রির কোনো প্রভাব পড়েনি। টিসিবির হিসাবে, এক মাস আগের তুলনায় গরুর মাংসের দাম কেজিতে ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৭৮০ টাকায়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে মাংসের দাম কমাতে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের উদ্যোগী হওয়া উচিত।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় যে প্রাণিজ আমিষ বিক্রি হচ্ছে, সেটি চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ফলে সার্বিক বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর এর কোনো প্রভাব নেই। তবে কিছু স্বল্প আয়ের মানুষ একটু কম দামে প্রাণিজ আমিষ পাচ্ছে।