ভাষার ভিন্নতা থেকে জীবনের বৈষম্য

আমি কেন সঠিক বাংলা বলতে পারি না, এটা কি আমার অপরাধ? ছোটবেলা থেকে নিজেকে এই প্রশ্ন করতে করতে বড় হয়েছি। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, আমার বেড়ে ওঠা যেখানে, তার সাপেক্ষে ভুল হোক আর শুদ্ধ, বাংলা বলতে পারাটাই চমৎকার এক ব্যাপার। বাংলাভাষীরা নতুন কোনো ভাষা শিখতে গিয়ে নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করেন। 

কিন্তু শুদ্ধ বাংলা বলতে না পারায় পরবর্তী সময়ে যখন বিভিন্ন সুযোগ থেকে বাদ পড়ে গেলাম, তখন মনে হলো, এটা বৈষম্য। আমিও এই বৈষম্যের শিকার। ভাষাগত কারণে বৈষম্যের শিকার হওয়া আমাকে কষ্ট দিয়েছে, এখনো দেয়। এই বৈষম্য কেবল ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি তারুণ্যের সাফল্যের পথে বাধা। 

ভাষা ও পরিচয়ের বৈষম্য

ছোটবেলা থেকেই পাহাড়ি উচ্চারণের কারণে বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছি। স্কুলে পড়ার সময় একবার আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। বিচারকেরা আমাকে বারবার ‘টাকা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে বললেন, কিন্তু বারবার আমার উচ্চারণ হতো ‘তাকা’। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর, কোন কলেজে পড়েছি প্রশ্ন করা হলে দুবার বলেছি, ‘আমি চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে পড়েছি।’ কিন্তু দুবারই শিক্ষক শুনলেন ‘চৌদ্দগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ’।

খাগড়াছড়ির পাহাড়ে যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, সহজাতভাবে আমার উচ্চারণে সেখানকার ছাপ স্পষ্ট। তবু জোর করে শুদ্ধভাবে বাংলা বলার চেষ্টা করি। নিজের অজান্তেই উচ্চারণের ভুলগুলো হয়। বাংলা ‘ট’, ‘ঠ’, ‘ত’ এবং ‘শ’, ‘ষ’, ‘স’ বর্ণগুলো উচ্চারণ করতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়। কারণ, আমার মায়ের মুখের ভাষার সঙ্গে বাংলার কিছুটা ভিন্নতা আছে। এ কারণে যাঁদের মাতৃভাষা বাংলা, তাঁরা আমাকে দুভাবে বিচার করেন।

প্রথম দলটি ভাবেন, আমি ‘খুব কিউট বাংলা’ বলি, বিদেশিরা যেমন আধো আধো বাংলা বলে। দ্বিতীয়ত, আমার ভুল বাংলা উচ্চারণ নিয়ে কেউ কেউ কৌতুক ও বিদ্রূপ করেন। 

আমার বাড়ি খাগড়াছড়ি; জন্ম চাকমা গোত্রে। আমার নৃতাত্ত্বিক ধরন মঙ্গোলীয়। এই পরিচয়ে তো আমার হাত ছিল না। এরপরও যখন পাহাড় থেকে সমতলে এলাম, তখন এসব বিষয় বাধা হয়ে উঠল। বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার পরও আমার বন্ধু-স্বজন ও আমি ‘চায়নিজ’, ‘চিংচুং’, ‘মিয়ানমারের লোক’, ‘আশ্রিত উপজাতি’ ইত্যাদি বিদ্রূপের শিকার হয়েছি।

পাহাড় থেকে যখন কেউ ঢাকায় প্রথম আসে বা পাহাড়ে কোনো ঘটনা ঘটে, তখন এসব বিদ্রূপ অনেক বেড়ে যায়। এর ফল হিসেবে দেশের সংখ্যালঘু বিভিন্ন জাতির অধিকাংশ মানুষ বড় শহরে এসেও নিজেদের ছোট গণ্ডিতে রাখেন। মানুষ হিসেবে নিজের অসীম সম্ভাবনাকে চাপা দিতে বাধ্য হন।

অনেকেই ভাবেন, এসব বৈষম্য হয়তো সমাজে স্বাভাবিকভাবে হয়ে থাকে। কিন্তু এসব স্বাভাবিকভাবে হয় না, বরং হতে দেওয়া হয়।

পাহাড়-সমতলে শিক্ষার অসমতা

সমতলের মতো পাহাড়ে উচ্চশিক্ষার সমান সুযোগ নেই। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো পার্বত্য জেলা বান্দরবানের খুমি জাতির কেউ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আর এই ২০২৫ সালে এসে খুমি জাতির প্রথম নারী শিক্ষার্থী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। একই সঙ্গে সমতলের সাঁওতাল, ওঁরাও এবং গারোদের মধ্যেও শিক্ষার এই বৈষম্য আছে। 

পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষদের ঢাকায় বা চট্টগ্রামে আসতে বাধ্য হতে হয় উচ্চশিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য। সমান পরিশ্রমী হওয়া সত্ত্বেও এখানে তাঁদের নারী-পুরুষ বৈষম্য, সামাজিক বিদ্রূপ এবং নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়িয়ে দেয়। 

নারী পরিচয় ও সামাজিক বৈষম্য

পাহাড়ের ঐতিহ্য ও দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে নারী-পুরুষ বৈষম্যের পরিমাণ কম। এমন একটা পরিবেশে বেড়ে ওঠা আমি ঢাকায় এসে দেখেছি, নারী পরিচয়টা এখানে আলাদা। শুধু নারী হওয়ার কারণে নানা ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হয়; রাতে বের হলে ধর্ষণের শিকার হওয়ার ভয় থাকে। পাশাপাশি সামাজিক নানা বিদ্রূপ তো আছেই। 

এসব কারণে যখন বিভিন্ন প্রকল্প, এনজিও, আত্মোন্নয়নমূলক কাজে অংশ নিই, তখন দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষদের প্রাধান্য দেওয়া হয়।  

এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গালাগালি, নোংরা ও অশালীন মন্তব্য এবং সাইবার বুলিং—এসবের শিকার আমাকে হতে হয়েছে। শুধু নারী হওয়ার কারণে আমাকে এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। 

রাষ্ট্র প্রত্যেকের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করলে তরুণ প্রজন্ম দেশের জন্য আরও বেশি অবদান রাখতে পারে
ছবি: মং হাই সিং মারমা

অর্থনৈতিক বৈষম্য ও স্বপ্নের সংঘাত

আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে অর্থনৈতিক সংকটে। আদতে এই অর্থনৈতিক সংকট আমাদের অধিকাংশ মানুষকেই বৈষম্যের মধ্যে রেখেছে। আমি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি। এরপরও পড়াশোনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসতে পেরেছি অনেক মানুষের সহায়তার কারণে। জীবনে একটু এগোনোর জন্য এখনো অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। 

কিন্তু চারপাশে তাকালে স্পষ্ট দেখি, আমার মতো হাজারো তরুণ-তরুণী দুর্বল অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তাঁদের জীবনের অসীম সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলছেন। 

রাষ্ট্র যদি প্রত্যেকের জন৵ মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করত, তাহলে এই তরুণ প্রজন্ম দেশের জন্য আরও বেশি অবদান রাখতে পারত। এত স্বপ্নের অকালমৃত্যু হতো না, যা আমাদের রাষ্ট্রের বোঝা বাড়িয়ে চলেছে। 

সমাজব্যবস্থায় বৈষম্য

মানুষ হিসেবে আমি অনেক দূর এগোতে চাই। দেশের অন্য সব নাগরিকের মতো আমার সম্ভাবনার সর্বোচ্চ বিকাশের চেষ্টা করতে চাই। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে যেসব বৈষম্য আমাদের সঙ্গে হচ্ছে, সেসব আমাদের নাগরিক হিসেবে পিছিয়ে দিচ্ছে। 

তুমি যদি দেখতে আলাদা হও, অন্যদের মতো না হও, যদি পাহাড়ে জন্ম হয় তোমার, যদি দরিদ্র হও তুমি, তোমার সঙ্গে যদি অন্যদের মতের মিল না হয়, তাহলে ধরে নেওয়া হচ্ছে তুমি অস্বাভাবিক; তোমার সঙ্গে বৈষম্য হওয়া স্বাভাবিক—আমাদের জীবন যেন এই চক্রে আটকা পড়ে গেছে।  

অনেকেই ভাবেন, এসব বৈষম্য হয়তো সমাজে স্বাভাবিকভাবে হয়ে থাকে। কিন্তু এসব স্বাভাবিকভাবে হয় না, বরং হতে দেওয়া হয়। 

বাংলাদেশ যদি সব নাগরিকের জন্য সংবিধান অনুযায়ী সমমর্যাদা ও জীবনের সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইত, তাহলে অবশ্যই তার প্রভাব সমাজে দেখতে পাওয়া যেত। অথচ রাষ্ট্রের মূল কাজ এটা। বিশেষ করে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে সারা দেশের মানুষের চাওয়া ছিল রাষ্ট্র তার দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করবে।

কিন্তু গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র সবার জন্য সমান মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করছে না। একই সঙ্গে সব নাগরিকের অর্থনৈতিক সাম্য, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকারের সমতাও নিশ্চিত করছে না। 

এই যে রাষ্ট্রের উদাসীনতা, এটিই মূলত বিদ্যমান কুসংস্কার, গোষ্ঠীগত আধিপত্য, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা টিকিয়ে রেখেছে। 

তবে বিভিন্ন অঙ্গনে বৈষম্য কমানোর বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ দেখা গেলেও কোনো সমন্বিত আন্দোলন চোখে পড়েনি। গণ–অভ্যুত্থানের পর যে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে ছিল, বাংলাদেশ সেই পথে নেই। 

যে স্বপ্ন দেখি

বাংলাদেশ রাষ্ট্র একমাত্র তখনই সামনে এগোতে পারবে, যখন আমরা দেশের সব মানুষকে সর্বোচ্চ মানের সচেতন, শিক্ষিত ও মানবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা করতে পারব। 

আমি এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে সব মানুষ একে অন্যের প্রতি মমতা ধারণ করবে; সবাই নিজের মতো করে নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে পারবে; উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কাজসহ সব মৌলিক অধিকার তার জন্য রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। 

আমার সব অর্জন নিয়ে আগামী দিনের সুন্দর একটা বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে চাই। নতুন জন্ম নেওয়া একটা শিশুর জন্য নিরাপদ ও সুন্দর বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই। 


হেমা চাকমা: কার্যনির্বাহী সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ