পরিপাটি পোশাকে গত বুধবার সকালে বাসা থেকে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাসের কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হন আবদুর রহিম (৪৫)। সকাল আটটায় রাজধানীর খিলক্ষেতে বাসে উঠেই পড়েন যানজটের কবলে। অনেক ঠেলেঠুলে প্রায় দুই ঘণ্টায় পৌঁছান উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকায়। একপর্যায়ে অধৈর্য হয়ে বাস থেকে নেমে হেঁটেই রওনা দেন গন্তব্যে।
ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আবদুর রহিমের সঙ্গে গাজীপুরের টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় দেখা। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। নষ্ট হয়ে গেছে পরিপাটি পোশাক। হেঁটে ক্লান্ত। তাই একটি চায়ের দোকানে বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন।
একটি ‘মহাদুর্ভোগের’ প্রকল্প
কথা বলতে চাইলে চরম বিরক্তি নিয়ে আবদুর রহিম বললেন, ‘আমাগোর কথা লেইখ্যা কী হইব! আমরা কি মানুষ নাকি! প্রতিদিন একই কষ্ট, একই সমস্যা! আমাগোর পেটের দায়। রোদে-বৃষ্টিতে ভিইজ্যা হইলেও অফিসে যাইতে হইব, গাড়ি না চললেও যাইতে হইব।’
২০১২ সালে ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট’ বা বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তারপর থেকে রাজধানীর উত্তরা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত এলাকার মানুষের অন্তহীন দুর্গতির শুরু। ৪ বছরের প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ হয়নি। যানজট, ধুলাবালু, খানাখন্দসহ নানা বিশৃঙ্খলায় এই উন্নয়নকাজ এখন মানুষের গলার কাঁটা।
মফিদুল ইমাম ও তাঁর পরিবারের চার সদস্য যাবেন ভারতের চেন্নাই। ফ্লাইট ছিল বুধবার বেলা ১১টায়। তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে সকাল সাতটায় বিমানবন্দরের উদ্দেশে বের হন। তবে যানজটের কারণে চার ঘণ্টা পর ১১টায় বিমানবন্দরে পৌঁছান। ততক্ষণে উড়োজাহাজ উড়ে গেছে। পরে তাঁরা নতুন করে টিকিট করে চেন্নাই যান। কারণ, চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁদের দেখা করার তারিখ ছিল পরদিন বৃহস্পতিবার।
মফিদুল ইমামের মতো অনেক যাত্রী এভাবে গত তিন দিনে ফ্লাইট মিস করেছেন। তবে তাঁর মতো যাঁদের নতুন করে টিকিট কিনে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, তাঁদের ভোগান্তি আরও অনেক বেশি।
রাজধানীর বনানী বা খিলক্ষেত থেকে গাজীপুরমুখী সড়কে প্রতিদিন আবদুর রহিম বা মফিদুল ইমামের মতো হাজারো মানুষকে অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয়, ফ্লাইটও মিস করতে হয় কাউকে কাউকে। যানজটে আটকা পড়ে ফ্লাইট মিসের আশঙ্কায় বিদেশে কর্মী হিসেবে কাজ করেন এমন অনেককে ব্যাগ-লাগেজ কাঁধে নিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়।
যানজটের কারণে বোর্ডবাজার থেকে টঙ্গী স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে এসেছি। হাঁটতে গিয়েও ধুলায় দমবন্ধ অবস্থা। মানুষের এত কষ্ট, সরকার কি চোখে দেখে না?বোর্ডবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. শাহিন
২০১২ সালে ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট’ বা বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তারপর থেকে রাজধানীর উত্তরা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত এলাকার মানুষের অন্তহীন দুর্গতির শুরু। ৪ বছরের প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ হয়নি। যানজট, ধুলাবালু, খানাখন্দসহ নানা বিশৃঙ্খলায় এই উন্নয়নকাজ এখন মানুষের গলার কাঁটা।
খোঁড়াখুঁড়ির কারণে খানাখন্দে ভরা সড়কে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়, কাদায় একাকার হয়ে যায়। বিআরটি প্রকল্পের কাজের কারণে সড়ক সংকুচিত হয়েছে। রাজধানীর আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়কে যত্রতত্র পড়ে আছে ইট, বালু, সিমেন্টসহ নানা নির্মাণসামগ্রী। ফলে গাড়ি চলাচল মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, বিমানবন্দর থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত সড়কটি উঁচুনিচু হলেও চলনসই। তবে আবদুল্লাহপুর থেকে টঙ্গী সেতু পার হলেই শুরু হয় এবড়োখেবড়ো আর খানাখন্দ। টঙ্গীর বাটাগেট, টঙ্গী বাজার, সেনাকল্যাণ ভবন, স্টেশন রোড ও মিলগেটের অবস্থা বেশি খারাপ। মিলগেট এলাকায় উভয়মুখী সড়কে সারা দিনই লেগে থাকে যানজট। মিলগেট থেকে চান্দনা চৌরাস্তা অংশে ছোট-বড় গর্ত থাকলেও হেলেদুলে গাড়ি চলে।
বৃষ্টি হলেই যানজট, রোদে ধুলা
একটু বৃষ্টি হলেই কাদা আর পানি জমে ভীতিকর রূপ দাঁড়ায় সড়কের। আবার শুষ্ক মৌসুমে সড়কের ধুলাবালু ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৃষ্টির কারণে চার দিন ধরে সড়কে যানজট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে ও সড়কে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃষ্টিতে গত সোম ও মঙ্গলবার পানি জমে সড়কে যানজট দেখা দেয়। সেই পানিনিষ্কাশনে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরদিন বুধবার সড়কের অবস্থা আরও খারাপ হয়। ভোর পাঁচটা থেকেই ময়মনসিংহমুখী সড়কে টঙ্গীর মিলগেট থেকে রাজধানীর বনানী এবং ঢাকামুখী সড়কে গাজীপুরের বোর্ডবাজার পর্যন্ত যানজট দেখা দেয়। বেলা একটার দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হলেও সন্ধ্যার পর আবার যানজট দেখা দেয়। গতকাল ভোর পর্যন্ত এই যানজট লেগে ছিল। সকালে রাজধানীর মহাখালীতে গিয়ে ঠেকে যানজট। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির উন্নতি হয়।
নিয়মিত যাত্রী ও স্থানীয় মানুষের ভাষ্য, সারা বছরই এই সড়কে কষ্ট পোহাতে হয়। বৃষ্টি হলে যানজট আর রোদে ধুলাবালুর যন্ত্রণা।
গতকাল দুপুরে বোর্ডবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. শাহিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যানজটের কারণে বোর্ডবাজার থেকে টঙ্গী স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে এসেছি। হাঁটতে গিয়েও ধুলায় দমবন্ধ অবস্থা। মানুষের এত কষ্ট, সরকার কি চোখে দেখে না?’
পরিবহনশ্রমিকদের পেটে টান
এই পথে প্রায় ২৬ বছর ধরে বাস চালান মো. রতন মিয়া। তাঁর সঙ্গে কথা হয় গাজীপুর আন্তজেলা বাস টার্মিনালে। তিনি বলেন, বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকে তাঁদের আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গাড়ির মালিক ও সহকারীদের টাকা দিয়ে কখনো কখনো তাঁর নিজের টাকাই থাকে না। বিআরটির কাজ শুরুর আগে গাজীপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে চারটি ট্রিপ দিতেন। এখন প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুটি ট্রিপ দিতে পারেন।