গবেষণার তথ্য
চিকিৎসক ও সাংবাদিক কে কাকে কী চোখে দেখেন
২১৯ জন চিকিৎসক ও ২০০ জন সাংবাদিকের মতামত নিয়ে গবেষণা হয়েছে। দরকার সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ।
চিকিৎসা ও সাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ দুই পেশা। গবেষণায় দেখা গেছে, সাংবাদিকতা পেশা ও সাংবাদিকদের দক্ষতায় ৫৪ শতাংশ চিকিৎসকের আস্থা কম। অন্যদিকে চিকিৎসকদের ব্যাপারে ৪৫ শতাংশ সাংবাদিকের বিশ্বাস নিম্নপর্যায়ের। এ ধরনের পরিস্থিতিতে গঠনমূলক আলোচনা, সংলাপ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দুই পেশাজীবীর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব বলে গবেষকেরা মনে করেন।
গবেষণাটি করেছেন ডিউক–ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউট, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের গণমাধ্যম অধ্যয়ন ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং বেসরকারি মুন্নু মেডিকেল কলেজের গবেষকেরা। তাঁদের গবেষণাটি গত মাসে কানাডা থেকে প্রকাশিত চিকিৎসা সাময়িকী ইন্টারঅ্যাকটিভ জার্নাল অব মেডিকেল রিসার্চ–এ মৌলিক প্রবন্ধ হিসেবে ছাপা হয়েছে। ১৪ পৃষ্ঠার প্রবন্ধে সাংবাদিক ও চিকিৎসক একে অন্যকে কী চোখে দেখে, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এমন একটি গবেষণা কেন করলেন, প্রথম আলোর এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিউক–ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌফিক জোয়ারদার বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের দ্বন্দ্বের কথা শোনা যায়। চিকিৎসকেরা অভিযোগ করেন, সাংবাদিকেরা না বুঝেই এমন কিছু লিখে ফেলেন, যা চিকিৎসকদের বিপক্ষে যায়। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকেও অভিযোগ আছে। এতে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সেই সংকটের প্রকৃতি বোঝার জন্য এবং সংকট নিরসনের পথ খুঁজতেই এ গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়।’
গবেষণায় ২১৯ জন চিকিৎসক ও ২০০ জন সাংবাদিককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চিকিৎসকদের গড় বয়স ৩৮ বছর এবং তাঁরা ১২ বছরের বেশি পেশা চর্চা করছেন। তাঁদের মধ্যে ৩১ শতাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অন্যদিকে সাংবাদিকদের গড় বয়স প্রায় ৩৪ বছর। তাঁদের গড়ে প্রায় ১০ বছর পেশার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের ৪৯ শতাংশ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন। চিকিৎসকদের ৪৩ শতাংশ এবং সাংবাদিকদের ৬২ শতাংশ ঢাকায় থেকে পেশা চর্চা করেন। চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের তিন–চতুর্থাংশ পুরুষ। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের মার্চ মাসের মধ্যে অনলাইন জরিপ করা হয়।
মাঝেমধ্যেই চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের দ্বন্দ্বের কথা শোনা যায়। চিকিৎসকেরা অভিযোগ করেন, সাংবাদিকেরা না বুঝেই এমন কিছু লিখে ফেলেন, যা চিকিৎসকদের বিপক্ষে যায়। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকেও অভিযোগ আছে। এতে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সেই সংকটের প্রকৃতি বোঝার জন্য এবং সংকট নিরসনের পথ খুঁজতেই এ গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
একের চোখে অন্য
গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ চিকিৎসকের মতে সাংবাদিকদের মধ্যে পেশাদারত্ব ‘খুব নিম্ন’ পর্যায়ে। অন্যদিকে ৩৩ শতাংশ সাংবাদিক মনে করেন, চিকিৎসকদের পেশাদারত্ব ‘খুব নিম্ন’ পর্যায়ের।
৭৪ শতাংশ চিকিৎসক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, সাংবাদিকেরা পর্যাপ্ত জ্ঞান না নিয়েই স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কে সংবাদ লেখেন ও প্রকাশ করেন। ৮৭ শতাংশ চিকিৎসক দৃঢ়ভাবে মনে করেন, সাংবাদিকেরা স্পর্শকাতর পন্থায় সংবাদ উপস্থাপন করেন। ৮৬ শতাংশ চিকিৎসক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, সাংবাদিকেরা চিকিৎসকদের যোগ্য মনে করেন না, বরং অমানবিক মনে করেন।
গবেষকেরা বলছেন, চিকিৎসক ও সাংবাদিক উভয়েরই একের প্রতি অন্যের নেতিবাচক মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তবে সাংবাদিকদের চেয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে অন্য পেশার মানুষের প্রতি নেতিবাচক ধারণা বেশি।
তবে চিকিৎসকদের ব্যাপারে তীব্র বা দৃঢ় মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ তুলনামূলকভাবে কম সাংবাদিকের মধ্যে দেখা যায়। বরং মাঝারি ধরনের অবস্থানই অধিকাংশ সাংবাদিকের মনোভাবে ফুটে উঠতে দেখা গেছে। যেমন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে বা সাক্ষাৎকার দিতে অধিকাংশ চিকিৎসক দক্ষ নন। এ বক্তব্যের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে একমত ১০ শতাংশ সাংবাদিক, এ বক্তব্যের সঙ্গে কিছুটা একমত ৫০ শতাংশ সাংবাদিক।
গবেষকেরা বলছেন, চিকিৎসক ও সাংবাদিক উভয়েরই একের প্রতি অন্যের নেতিবাচক মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তবে সাংবাদিকদের চেয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে অন্য পেশার মানুষের প্রতি নেতিবাচক ধারণা বেশি। নারী ও বেশি বয়সী চিকিৎসদের মধ্যে সাংবাদিকদের ব্যাপারে ধারণা তুলনামূলকভাবে ভালো।
আইইডিসিআরের প্রশিক্ষণে সাংবাদিকদের আনা হয়। আবার বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষণে জনস্বাস্থ্যবিদেরা প্রশিক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকেন। এতে পরিস্থিতির ইতিবাচক উন্নতি ঘটছে। পাশাপাশি প্রতিটি গণমাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের জন্য নির্দিষ্ট সাংবাদিককে দায়িত্ব দেওয়া হলে ভুলত্রুটি এবং ভুল–বোঝাবুঝি কমে আসবে বলে আশা করা যায়।
প্রবন্ধের শেষ দিকে গবেষকেরা বলেছেন, পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে দুই পেশাজীবীর একে অন্যের কাজকে জানা–বোঝার উদ্যোগ বাড়াতে হবে। মেডিকেল কলেজগুলোয় শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ দক্ষতায় জোর দিতে হবে। অন্যদিকে সাংবাদিকতার শিক্ষাক্রমে জনস্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
গবেষণায় বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইইডিসিআরের প্রশিক্ষণে সাংবাদিকদের আনা হয়। আবার বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষণে জনস্বাস্থ্যবিদেরা প্রশিক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকেন। এতে পরিস্থিতির ইতিবাচক উন্নতি ঘটছে। পাশাপাশি প্রতিটি গণমাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের জন্য নির্দিষ্ট সাংবাদিককে দায়িত্ব দেওয়া হলে ভুলত্রুটি এবং ভুল–বোঝাবুঝি কমে আসবে বলে আশা করা যায়।’