অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অপরাধের পর্যায়ে পৌঁছেছে

  • ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকে আক্রান্ত মানুষ ওষুধে সুস্থ হয়ে উঠছেন না।

  • ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে এই কারণে ১২ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। একই সময়ে বাংলাদেশে অনুমিত ২৬ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে কোনো কোনো জীবাণু ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে

দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার অপরাধের পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলেন, সামান্য কারণে বাছবিচারহীনভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের সুফল পেতে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি পেশাজীবী চিকিৎসকদের সতর্ক ভূমিকা জরুরি হয়ে পড়েছে।

গতকাল সোমবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মিল্টন হলে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষকেরা এসব কথা বলেন। ‘জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকের সংবেদনশীলতা’ শিরোনামের এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিএসএমএমইউর মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগ। অনুষ্ঠানে পৃথক তিনটি মূল বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়।

একটি উপস্থাপনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, কিছু অ্যান্টিবায়োটিক সংরক্ষিত হিসেবে বিবেচিত। এগুলো শেষ আশ্রয়স্থল। একান্ত বিপদে না পড়লে সেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত না; কিন্তু সামান্য কারণে এসব অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রে লেখা হচ্ছে। এটা অপরাধ।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বলা হয়, ওষুধের যথেচ্ছ ও অযৌক্তিক ব্যবহার হচ্ছে। সে কারণে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাক ওষুধ–প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। তাই ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকে আক্রান্ত মানুষ ওষুধে সুস্থ হয়ে উঠছেন না। মানুষ মারা যাচ্ছেন। এ সমস্যা বিশ্বজুড়ে। ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে এই কারণে ১২ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। একই সময়ে বাংলাদেশে অনুমিত ২৬ হাজার বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

কিছু অ্যান্টিবায়োটিক সংরক্ষিত হিসেবে বিবেচিত। এগুলো শেষ আশ্রয়স্থল। একান্ত বিপদে না পড়লে সেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত না; কিন্তু সামান্য কারণে এসব অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রে লেখা হচ্ছে। এটা অপরাধ।
অধ্যাপক মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএমইউ

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের আইন বলছে নিবন্ধনকৃত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো ওষুধের দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা নিষেধ। এই আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি এটা নিশ্চিত করতে হবে যে কার্যকারিতা অনুসন্ধান না করে কোনো চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লিখবেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৭২ হাজার ৬৭০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহেদা আনোয়ার। তিনি বলেন, এর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে ১৫ হাজার ৭৫১টি নমুনায়। এরপর তিনি কোন কোন ব্যাকটেরিয়া কোন কোন অ্যান্টিবায়োটিকে কী পরিমাণে প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে তার তথ্য দেন। কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে কোনো কোনো জীবাণু ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।

শাহেদা আনোয়ার বলেন, কলিস্টিনকে সবচেয়ে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে কলিস্টিন হচ্ছে সংরক্ষিত শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক। কিন্তু নমুনা পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষেত্রে তা কাজ করছে না। অন্য উপস্থাপনায় একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চন্দন কুমার রায় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগার এখন বিরল প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করতে সক্ষম।

অনুষ্ঠানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউতে থাকা রোগীদের চিকিৎসায় জটিলতা নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়। আইসিইউতে থেকে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার প্রবণতা বেশি। হাসপাতালে মানুষ একটি রোগের চিকিৎসার জন্য আসেন, এসে তাঁরা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অন্য রোগে আক্রান্ত হন। এটি এখন একটি বৈশ্বিক প্রবণতা। এ ছাড়া ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হওয়া শুধু চিকিৎসাবিষয়ক সমস্যা নয়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম আলী আহমেদ বলেন, একটি অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করলে অন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এতে রোগীর হাসপাতালে থাকার সময় বাড়ে, খরচ বাড়ে। রোগী যদি আইসিইউতে থাকেন, তাতে খরচ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এটা ব্যক্তি ও পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ বাড়াচ্ছে।

অনুষ্ঠানে করণীয় বিষয়ে আলোচনা হয়। এস এম আলী আহমেদ বলেন, কোনো চিকিৎসক সংরক্ষিত শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিলে ব্যবস্থাপত্রে তার কারণ লিখবেন। মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, বিএসএমএমইউর নিজস্ব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারবিধি ২০১৪ সালের পর আর হালনাগাদ করা হয়নি, এটি হালনাগাদ করা দরকার। অ্যান্টিবায়োটিক–বিষয়ক আইনের যথাযথ প্রয়োগের ওপর জোর দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তবে প্রায় সবাই মানুষকে সচেতন করার ওপর গুরুত্ব দেন।