৩০ বছরে কয়েক শ কোটি টাকা ব্যয়, কিন্তু কতজন তাঁতির পুনর্বাসন হলো

পাবনার ঈশ্বরদীতে বেনারসিপল্লিতে গুটিকয় প্লটে তাঁত রয়েছে, সেখানে বোনা হয় বেনারসি শাড়িছবি: হাসান মাহমুদ

গত ৩০ বছরে কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে একজন তাঁতিকেও পূর্ণাঙ্গভাবে পুনর্বাসন করতে পারেনি বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড (বাতাঁবো), অথচ এ জন্য ব্যয় হয়েছে ৪৩২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বরাদ্দ পাওয়া একরের পর একর জায়গা কোনো কাজেই লাগছে না। এ জন্য তাঁতিরা দায় চাপাচ্ছেন বোর্ডের ঘাড়ে, আর বোর্ড দায়ী করছে তাঁতিদের।

রাজধানীর মিরপুরের ভাষানটেকে বেনারসিপল্লির তাঁতিদের পুনর্বাসনে প্রকল্প নেওয়া হয় ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০০৭ সালের জুন মাসে শেষ হয় প্রকল্পের কাজ। এতে খরচ হয় ১৮ কোটি ৮১ লাখ ১২ হাজার টাকা। পুনর্বাসনের জন্য ৪০ একর জায়গা বরাদ্দ ছিল, তবে তাঁত বোর্ডের দখলে এখন আছে মাত্র ৩ একর। এ জায়গায় এখন ১১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড কমপ্লেক্স স্থাপন প্রকল্পের কাজ চলছে।

পাবনার ঈশ্বরদীতে বেনারসিপল্লি প্রকল্পে কাজ শুরু হয়েছিল ২০০০ সালের জুলাই মাসে, শেষ হয় ২০০৪ সালের জুনে। এতে খরচ হয় ২ কোটি ১২ লাখ টাকা। শহরের ফতে-মোহাম্মদপুর এলাকায় ৫ দশমিক ৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

হাজী শরীয়তউল্লাহ ‘তাঁত পল্লী’ স্থাপন প্রকল্প (আগের নাম ছিল শেখ হাসিনা তাঁত স্থাপন প্রকল্প) শুরু হয় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে, শেষ হয় ২০২৩ সালের জুনে। এতে খরচ হয় ২৯৬ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে প্রায় ১২০ একর জমিতে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে।

১৯৯৫ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত তাঁতিদের পুনর্বাসনে সব মিলিয়ে ১৬৫ একরের বেশি জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা কাজেই লাগছে না। প্রকল্প এলাকাগুলোর কোনোটিতে সবজি চাষ হচ্ছে, কোনোটিতে ধু ধু মাঠ আবার কোনোটি সাইনবোর্ডসর্বস্ব হয়ে আছে।

ঢাকার মিরপুরে বেনারসিপল্লির তাঁতিদের পুনর্বাসন এবং তাঁত বোর্ড কমপ্লেক্স স্থাপনে ১৩৩ কোটি টাকার, পাবনার ঈশ্বরদীতে ২ কোটি ১২ লাখ টাকার, শরীয়তপুর–মাদারীপুরে ‘তাঁত পল্লী’ স্থাপনে ২৯৬ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৬৫ একর জমি বরাদ্দ হয়।

তাঁত বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন কিছু বলতে পারছেন না। বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু আহমেদ ছিদ্দিক রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বোর্ডের কার্যালয়ে বসে প্রথম আলোকে বলেন, মিরপুরের ভাষানটেকে দুটি মামলা চলমান থাকায় পুনর্বাসন কার্যক্রম চালাতে সমস্যা হচ্ছে।

পুনর্বাসন প্রকল্প সফল না হওয়ার পেছনে তাঁতিদের অনীহাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরে তিনি বলেন, ঈশ্বরদীতে তাঁতিরা রেলওয়ের জায়গায় থাকেন, তাঁরা সে জায়গা হারাতে চান না। তবে এই তাঁতিদের প্রকল্প এলাকায় গিয়ে ব্যবসা করতে চাইলে সে সুযোগ এখনো আছে।

পাবনার ঈশ্বরদীতে বেনারসিপল্লিতে প্রায় সব প্লটই এমন পড়ে আছে, কিছু প্লটে হচ্ছে সবজি চাষ
ছবি: হাসান মাহমুদ

ঈশ্বরদীতে প্রকল্প এলাকায় সবজি চাষ

প্রথম আলোর পাবনা প্রতিনিধি হাসান মাহমুদকে নিয়ে গত ৩০ অক্টোবর ঈশ্বরদীর প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাচায় করলা ঝুলছে। স্থানীয়রা এই সবজি চাষ করেছেন। প্রকল্প এলাকায় বড় একটি মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। অবশ্য একটি লম্বাটে ঘরে কয়েকজন তাঁতিকে পাওয়া গেল, যাঁরা বেনারসি বুনছেন। কথা বলতে চাইলে তাঁরা চরম অনীহা প্রকাশ করলেন। কারণ জানতে চাইলে বললেন, তাঁরা একই কথা বলতে বলতে ক্লান্ত।

গত ৩০ নভেম্বর ছিল এই প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহ জামালের শেষ কর্মদিবস। এর আগে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তিনিই এখানকার একমাত্র কর্মকর্তা, তাই বেনারসিপল্লি প্রকল্পের অফিস সামলানোর পাশাপাশি এ প্রকল্পের বাইরে বোর্ডের দেওয়া ঋণ কার্যক্রম তদারকি করাসহ অন্যান্য কাজ করতে হয়েছে। এর আগে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরাও এভাবেই কাজ করেছেন।

এ প্রকল্প এলাকায় মোট ৯০টি প্লট রয়েছে, এর মধ্যে ৫ শতাংশ আয়তনের ২০টি এবং ৩ শতাংশ আয়তনের ৭০টি। ৫ শতাংশ প্লটের মাসিক কিস্তি ৬৫০ টাকা এবং ৩ শতাংশ প্লটের মাসিক কিস্তি ৩৯০ টাকা, কিস্তির মেয়াদ ২০ বছর নির্ধারিত ছিল।

শাহ জামাল জানান, ২০টি প্লটের মালিক সম্পূর্ণ কিস্তি পরিশোধ করেছেন, যার মধ্যে ৪টি প্লটের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। অনিয়মিত কিস্তি দেওয়ার কারণে ১৪টি প্লটের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় দুটি কারখানায় ১৩টি তাঁত চালু আছে।

পাবনার ঈশ্বরদীতে বেনারসিপল্লিতে কিছু প্লটে কারখানা বসেছে। তবে যে তাঁতিরা প্লট নিয়েছেন, তাঁরা এই কারখানা বসাননি
ছবি: হাসান মাহমুদ

প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এলাকার তাঁতিদের পুনর্বাসন করা। কিন্তু নিয়ম না মেনে মূল মালিকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন বা কিনে নিয়েছেন, এমন মালিকেরা এখন এখানে তাঁত বসিয়ে ব্যবসা করছেন। তবে তাঁদের দাবি, তাঁরাই এ প্রকল্পটাকে কিছুটা হলেও বাঁচিয়ে রেখেছেন।

রাজধানীর মিরপুরের তাঁতি মো. নাসিম গত ১৫ বছর ধরে ঈশ্বরদীর প্রকল্প এলাকায় তাঁত চালাচ্ছেন। তিনি দাবি করেন, তিনি প্লটমালিকের কাছ থেকে এটি কিনে নিয়েছেন। বর্তমানে ১১টি তাঁত চালু আছে। এখানে শাড়ি বানানোর পর ঢাকার বিভিন্ন বড় বড় শোরুমে বিক্রি করেন।

‘এলাকার নাম হয়েছে বেনারসিপল্লি। আমার কথাই যদি ধরেন, ২০০০ সাল থেকে ২০২৫ সাল, পুনর্বাসন বলতে লম্বায় ৪০ ফিট আর পাশে ৩২ ফিটের জায়গায় ঘর বানিয়ে বিনা মূল্যে থাকতে পারছি। এলাকায় ঘরে ঘরে কম করে হলেও ১০টি করে তাঁত ছিল। এখন খুঁজে বের করতে হয়।
মো. মুরাদ, ভাষানটেক বেনারসিপল্লির বাসিন্দা

এই প্লট কেনা বা বিক্রি করা যায় না বলা হলে নাসিম বলেন, ‘ঠিক আছে, বিক্রি বা কেনা যায় না। তবে শুধু আমি না, আরও অনেকে কিনছে। আর মূল মালিকেরা বিক্রি করছে কেন? আমরা তো আর জোর করে কিনি নাই।’

রাজধানীর মিরপুরের আরেক তাঁতি মো. শামীম আহমেদও ঈশ্বরদীতে মূল ফ্ল্যাটমালিকের স্ত্রীর কাছ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া নিয়ে তাঁত চালাচ্ছেন বলে জানান।

প্রকল্প এলাকায় বেনারসি শাড়ি বিক্রির জন্য মার্কেট প্রমোশন সেন্টারসহ অনেক কিছু করার ছিল। একদিকে তাঁতিরা সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করেননি, অন্যদিকে প্রকল্প এলাকায় মসজিদ, রাস্তাঘাট করা ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাও করা হয়নি। ফলে প্রকল্পের সুফল মেলেনি।

ঢাকার ভাষানটেকে বেনারসিপল্লির সাইনবোর্ডটি কেবল আছে, কিন্তু প্রকল্প এলাকায় কোনো প্লট ৩০ বছরেও বরাদ্দ পাননি তাঁতিরা
ছবি: মানসুরা হোসাইন

ভাষানটেকে শুধু সাইনবোর্ড

ঢাকার মিরপুরের তাঁতি মোহাম্মদ রফিক বেনারসিপল্লি, মিরপুর প্রকল্পের কারখানা কাম-আবাসিক প্লট বরাদ্দের আবেদন করেছিলেন। তাঁত বোর্ডের সিল লাগানো ফরমে আবেদন ও জামানত বাবদ ১০ হাজার টাকা পে-অর্ডার করেছিলেন ২০০৩ সালে। কিন্তু একজনও প্লট বরাদ্দ পাননি। নতুন প্রকল্প হওয়ায় এখন পুনর্বাসন প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

বেনারসি শাড়ি তৈরির জন্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পুরস্কার পাওয়া মোহাম্মদ রফিক আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বললেন, বেনারসিপল্লির শুধু নামটাই আছে। তাঁতিদের অনেকেই এখন রিকশা–ভ্যান চালান, বিরিয়ানি বিক্রি করেন, বাসের হেলপারি করেন।

প্রকল্প এলাকায় বেশ কয়েকটি টিনের কালো রঙের বোর্ডে সাদা কালিতে লেখা রয়েছে- বেনারসিপল্লি মিরপুর, মৌজা-জোয়ার সাহারা, জমির পরিমাণ-৪০ একর, জমির মালিক বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।

মিরপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁত সমিতির সাবেক সভাপতি, ৬৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ রফিক পুনর্বাসনে ব্যর্থতার জন্য তাঁত বোর্ডের আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করছেন। তিনি বলেন, প্রকল্প যদি কখনো বাস্তবায়িত হয়ও, তাহলে যেন আসল তাঁতিরা সুযোগ পান।

রফিকের কাছ থেকে জানা গেল, মিরপুর ভাষানটেকে ৪০ একর জায়গায় তাঁত পল্লী স্থাপনে ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় এবং মাটি ভরাটের জন্য সাড়ে ৮ কোটি টাকা এবং জমির মূল্য ১১ কোটি ৩২ লাখ টাকা পরিশোধের উদ্যোগ নেয়।

১ হাজার ৮৬৭ জন তাঁতি ২০০৩ সালে প্রকল্পের প্লটের জন্য ১০ হাজার টাকা করে পে-অর্ডার করেছিলেন। এই তাঁতিদের মধ্য থেকে লটারির মাধ্যমে ৯০৬ জনকে ৩ শতাংশের একেকটি করে প্লট দেওয়ার কথা ছিল। অবশ্য পরে অনেক তাঁতি জামানত তুলে নেন।

প্রকল্পটির পূর্ত কাজের দায়িত্বে থাকা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালে তাঁত বোর্ডকে ৪০ একর জমি নিবন্ধন করে দেয়। এখানে ভূমি উন্নয়ন, এস্টেট অফিস কাম বেসিক সেন্টার, ডাইং ও ফিনিশিং ফ্যাক্টরি, স্কুল, মসজিদ, খেলার মাঠসহ অন্যান্য স্থাপনা তৈরির কথা ছিল। তবে মাটি ভরাট (৮৬ শতাংশ) এবং সীমানাপ্রাচীরের (১৭ শতাংশ) কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

ঢাকার ভাষানটেকে বেনারসিপল্লি বাদ দিয়ে এখন তাঁত বোর্ড কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

এ প্রকল্প এলাকায় একসময় বস্তি ছিল। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। পুনর্বাসন না করেই বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, এ অভিযোগে তখন থেকে উচ্ছেদ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একাধিক রিট মামলা হয়, দুটি এখনো চলছে। বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ কার্যক্রমের ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। বস্তিবাসীদের পাশাপাশি ভাষানটেকে বসবাসকারী আব্দুল মান্নান এবং অন্যান্যরা মিলে হাইকোর্ট বিভাগে ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল বেনারসিপল্লির ৪০ একর জায়গায় তাঁতিদের প্লট বরাদ্দসহ সেখানে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ না করার জন্য নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য দেখাচ্ছে, ১৯৯০ সালে দেশে তাঁতি ছিলেন ১০ লাখ ২৭ হাজার ৪০৭ জন, ২০১৮ সালে এসে সংখ্যাটি কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ১ হাজার ৭৫৭ জনে। এর কারণ দেখানো হয়, অন্য পেশায় বেশি আয়, মূলধনের অভাব, তাঁতপণ্য বিক্রির জন্য শক্তিশালী বাজারব্যবস্থা না থাকা।

আইনি জটিলতার মধ্যে আবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় প্রকল্পে ধীরগতি নেমে আসে বলে তাঁত বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানান। ২০১৪ সালের ১৮ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বেনারসিপল্লি ঢাকার বাইরে খোলামেলা পরিবেশে স্থানান্তর করতে হবে। এরপর ২০২৪ সালের ২৮ মার্চ একনেকে মিরপুরের ভাষানটেক প্রকল্পের ৩ একর জায়গায় বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড কমপ্লেক্স স্থাপন প্রকল্প অনুমোদন পায়। এতে ১০ তলাবিশিষ্ট তাঁত ভবন, তাঁত বোর্ডের প্রধান কার্যালয়, বেসিক সেন্টার, মিলনায়তন, প্রদর্শনী কাম বিক্রয়কেন্দ্র, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হবে।

ঢাকার ভাষানটেকে এখন চা–দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন বেনারসিপল্লির মো. মুরাদ
ছবি: মানসুরা হোসাইন

গত ১৮ নভেম্বর প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কমপ্লেক্সটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাস্তবায়ন করছে বলে সাইনবোর্ড লেখা রয়েছে। ভূমি সমান করার কাজ চলছে। প্রকল্প এলাকার এক প্রান্তে এখনো কোনোমতে টিকে আছেন ৬৮ বছর বয়সী মো. মুরাদ। তাঁর তাঁত রাখা ঘরটি প্রকল্পের মাটিতে প্রায় ঢেকে গেছে, দরজা–জানালা খোলা যায় না।

১৮ নভেম্বর দুপুরে মো. মুরাদের বাসা ও ভাড়া নেওয়া মুদির দোকানে বসে কথা হয়। ২০০০ সালের আগেও তাঁর নিজের তাঁত ছিল ১৮টি, কারিগরসহ কর্মীর সংখ্যা ছিল ৩৮ জন। মুরাদ বলেন, তাঁতের সংখ্যা ১৮ থেকে ১০, তারপর ১টিতে নেমে আসে। এখন বন্ধ। তাঁতি মুরাদের পরিচয় ৫ বছর ধরে মুদির দোকানি। বাসার কাছে হাঁটা দূরত্বেই এ দোকান আর দুই ছেলের উপার্জনে চলছে তাঁর সংসার।

মো. মুরাদ ছোটবেলা থেকেই তাঁতে বেনারসি বুনছেন। ১৯৮২ সালে শ্রমিক থেকে মিরপুর ১০ নম্বরে ১৮টি তাঁত দিয়ে নিজেই কারখানা চালু করেন। প্রায় তিন দশক আগে সিটি করপোরেশন মার্কেট বানানোর জন্য তাঁতিদের মিরপুর ১০ নম্বর থেকে উচ্ছেদ করলে মুরাদসহ অন্যদের ভাষানটেকে এনেছিল সরকার।

ভাষানটেকের পল্লিতে প্লটের জন্য আবেদন করেছিলেন মুরাদ। পুনর্বাসন হলো, এ প্রশ্নের উত্তর থেমে থেমে দিলেন তিনি; বললেন, ‘এলাকার নাম হয়েছে বেনারসিপল্লি। আমার কথাই যদি ধরেন, ২০০০ সাল থেকে ২০২৫ সাল, পুনর্বাসন বলতে লম্বায় ৪০ ফিট আর পাশে ৩২ ফিটের জায়গায় ঘর বানিয়ে বিনা মূল্যে থাকতে পারছি। এলাকায় ঘরে ঘরে কম করে হলেও ১০টি করে তাঁত ছিল। এখন খুঁজে বের করতে হয়।’

পুত্রবধূর জন্য নিজেই এই বেনারসি বানিয়েছিলেন মো. মুরাদ, শাড়িটি সযতনে রেখে দিয়েছেন তিনি
ছবি: মানসুরা হোসাইন

ভাষানটেকে মুরাদের মতো অনেককে আনা হলেও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় তাঁদের কোনো প্লট দেওয়া হয়নি। শুধু থাকতে পারছেন তাঁরা।

মুরাদের দুই ছেলে, দুই মেয়ের কেউ বাবার পেশায় আসেননি। ১০ বছর আগে বড় ছেলের বিয়েতে বউয়ের জন্য লাল বেনারসি শাড়িটি নিজের হাতে বানিয়েছিলেন মুরাদ। লালের মধ্যে ঘিয়ে পাড় ও আঁচল। জরির ফুলেল নকশা পুরো শাড়িতে। মুরাদের বাসায় গেলে প্রতিবেদককে শাড়িটি দেখানোর পর ছেলের বউ তা ভাঁজ করছিলেন। মুরাদ একটু পরপর বলছিলেন, ‘আহা, ভাঁজটা হচ্ছে না তো।’ তারপর একসময় নিজেই তা ভাঁজ করলেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হস্তচালিত তাঁত শুমারি ২০১৮–এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯০ সালে দেশে ১০ লাখ ২৭ হাজার ৪০৭ জন তাঁতি ছিলেন। ২০১৮ সালের শেষে সংখ্যাটি কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ১ হাজার ৭৫৭ জনে। তাঁত কমে যাওয়া বা অন্য পেশায় তাঁতিরা কেন চলে যাচ্ছেন, তার কারণ হিসেবে সেই প্রতিবেদনে বলা হয় অন্য পেশায় আয় বেশি। মূলধনের অভাব এবং তাঁতপণ্য বিক্রির জন্য শক্তিশালী বাজারব্যবস্থা না থাকাকেও কারণ হিসেবে দেখানো হয় সেই প্রতিবেদনে।

শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীপুরের শিবচরের প্রায় ১২০ একর জমি নিয়ে হবে ‘তাঁত পল্লী’। তার কাজ এখনো চলছে
ছবি: সত্যজিৎ ঘোষ

পুনর্বাসনের আশা এখনো

ঢাকা–শরীয়তপুর সড়কের পাশে ‘শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী’ নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এবং মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুরের প্রায় ১২০ একর জমিতে প্রকল্পের উদ্বোধন হয়। ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর একনেকে (সংশোধিত) প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছিল।

গত বছর ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন প্রকল্পের নাম ‘হাজী শরীয়তউল্লাহ তাঁত পল্লী’ করার প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরুর অপেক্ষায় আছে।

প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়নে মাটি ভরাট ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি ২০২৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন, এরপর প্রকল্পে নিয়মিত কোনো প্রকল্প পরিচালক ছিলেন না।

প্রথম আলোর শরীয়তপুর প্রতিনিধি সত্যজিৎ ঘোষ সম্প্রতি সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে এসে জানিয়েছেন, সীমানাপ্রাচীরের মধ্যে প্রকল্প এলাকায় ধু ধু বালু, কোনো কোনো জায়গায় ঘাস, দু–একটি সাইনবোর্ড, প্রকল্প উদ্বোধনের নামফলক আর আনসার ব্যারাক আছে।

শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীপুরের শিবচরের ‘তাঁত পল্লী’ স্থাপনে ব্যয় হচ্ছে ২৯৬ কোটি টাকা
ছবি: সত্যজিৎ ঘোষ

তাঁত বোর্ডের দেওয়া তথ্য বলছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পে তাঁতিদের জন্য দোতলাবিশিষ্ট আবাস-কাম কারখানা ভবন হবে ১ হাজারটি। এ ছাড়া ডিসপ্লে-কাম সেলস সেন্টার, ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, বস্ত্র প্রক্রিয়াকরণ কাঁচামাল বিক্রয়কেন্দ্র, তাঁতিদের জন্য বয়ন পূর্ব ও বয়নোত্তর সার্ভিস/ক্লথ প্রসেসিং সেন্টার, ফ্যাশন ডিজাইন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, স্টেট অফিস, তথ্য কেন্দ্র, সাইবার সেন্টার, ব্যাংক, ভিআইপি গেস্টহাউস, অফিসার ও স্টাফ ডরমিটরি ভবন, তাঁতশিল্পি ডরমিটরি ভবন, প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ২টি, মসজিদ, কমিউনিটি ক্লিনিক, কমিউনিটি সেন্টার, তাঁত সমিতি কেন্দ্র, গ্রসারি শপ, আনসার ব্যারাক, স্মৃতিস্তম্ভ, রেস্টুরেন্ট, খেলার মাঠ, শিশুপার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, গণশৌচাগার, জলাধার/লেক, আরভরি কালচার, বনায়নসহ অন্যান্য সড়ক ও স্থাপনা তৈরি হবে।

তবে মিরপুরের ভাষানটেকের মোহাম্মদ রফিক, মো. মুরাদসহ অন্য তাঁতিরা আর আশ্বস্ত হতে পারছেন না যে তাঁরা আসলেই পুনর্বাসনের সুযোগ পাবেন।