চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ভবনগুলো যেন মৃত্যুফাঁদ
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সকালের ঘটনা। চট্টগ্রাম নগরের আমিরবাগ আবাসিক এলাকার শিক্ষার্থী খন্দকার জেবা ফারিহা নির্মাণাধীন একটি ভবনের পাশ দিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। হঠাৎই কী মনে করে রাস্তার অপর পাশে সরে যায় এই ছাত্রী। ঠিক ওই মুহূর্তে নির্মাণাধীন ভবনের ওপর থেকে লোহার পাত এসে পড়ে রাস্তার ওপর। পথ পরিবর্তন করায় সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায় জেবা ফারিহা। তবে ঘটনার এক মাস পরও মন থেকে আতঙ্ক দূর করতে পারেনি এই এসএসসি পরীক্ষার্থী।
ফারিহা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার মতো সৌভাগ্যবান ছিলেন না ৫০ বছর বয়সী রন ভট্টাচার্য। ফারিহার ঘটনার ঠিক ছয় দিন পরই নগরের জামালখানে একই ধরনের আরেকটি ঘটনায় মারা গেছেন তিনি। জামালখানে নতুন ভবন করার জন্য পুরোনো ভবন ভাঙা হচ্ছিল। এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেয়াল ধসে পড়ে রন ভট্টাচার্যসহ কয়েকজনের ওপর। এতে তিনিসহ মারা যান দুজন। এ সময় সেখানে কোনো সুরক্ষাব্যবস্থা ছিল না।
স্কুলছাত্রী খন্দকার জেবা ফারিহার পিতা মঈন উদ্দীন হোছাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। আবাসন কোম্পানির চরম গাফিলতির জন্য আমার মেয়ে মারাও যেতে পারত। ভবনমালিকেরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভবন করতে পারেন, আর কিছু টাকা দিয়ে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন না? তাঁদের কাছে মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই।’
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা না থাকার কারণে নির্মাণাধীন ভবন বা পুরোনো ভবন ভাঙার সময় চট্টগ্রামে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এতে নির্মাণশ্রমিকদের জীবন যেমন বিপন্ন হয়ে পড়েছে, তেমনি পথচারীসহ প্রতিবেশীরাও ঝুঁকিতে পড়ছেন।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, নির্মাণাধীন ভবনের নিরাপত্তা বিধান এবং সেই অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ভবনমালিক ও নিয়োজিত কারিগরি ব্যক্তিদের। জনবলসংকটের কারণে সার্বক্ষণিক তদারকি সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর চট্টগ্রামে নির্মাণকাজ চলার সময় অন্তত ৩৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও মৃত্যুর হিসাব রাখে।
এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি নগরের বাকলিয়ার কল্পলোক আবাসিক এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করার সময় তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল। গত ২৮ ডিসেম্বর নগরের খুলশীর লালখান বাজার এলাকায় কাজ করার সময় ভবন থেকে পড়ে মারা যান এক শ্রমিক।
নগর-পরিকল্পনাবিদেরা মনে করেন, এসব দুর্ঘটনার জন্য তদারকি সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ভূমিকাও কম দায়ী নয়।
তবে সিডিএ দাবি করেছে, নির্মাণাধীন ভবনের নিরাপত্তা বিধান এবং সেই অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ভবনমালিক এবং ভবন নির্মাণে যুক্ত পেশাজীবী (প্রকৌশলী ও স্থপতি) ব্যক্তিদের।
অনেক সময় ভবনের নির্মাণকাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীরা ঠিকভাবে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন না। তবে নির্মাণকাজের সময় দুর্ঘটনার মূল দায় ভবনমালিকদের। কেননা, তাঁদের নির্দেশনা দেওয়া হলেও খরচ বাঁচানোর জন্য তাঁরা সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেন না। এতে প্রকৌশলীদেরও কিছু করার থাকে না
সিডিএর ইমারত নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান ও উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারী প্রথম আলোকে বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, নির্মাণাধীন ভবনের নিরাপত্তা বিধান এবং সেই অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ভবনমালিক ও নিয়োজিত কারিগরি ব্যক্তিদের। নগরে শত শত ভবনের নির্মাণকাজ চলে। জনবলসংকটের কারণে সার্বক্ষণিক তদারকি সম্ভব হয় না। তবে ভবনমালিক এবং ভবন নির্মাণে যুক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কারিগরি ব্যক্তিরা নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে সচেতন হলে নির্মাণজনিত দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব।
ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সিডিএর দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে—নির্মাণকাজ চলাকালে পাশের জায়গা বা ইমারতের কোনো ক্ষতি সাধন করা যাবে না। ভবনের নির্মাণকাজ চলার সময় রাস্তা ও ফুটপাতে কোনো নির্মাণসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি রাখা যাবে না। মানুষের ও যান চলাচল বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। ইমারত নির্মাণের সময় যেন কোনো ধরনের দুর্ঘটনা বা জানমালের ক্ষতি না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, এর দায়দায়িত্ব ইমারত নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বা মালিকের। ভবনের নির্মাণকাজ ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহন, মজুত ও সংরক্ষণে পরিবেশসম্মত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ধরনের ধূলিদূষণ যাতে না হয়, সে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া নির্মাণকাজ শুরুর ১৫ দিন আগে সিডিএকে অবহিত করার শর্তও রয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত বিধিমালায় এ ধরনের সুপারিশ রয়েছে। তবে এসব সুপারিশ প্রায় সময় কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। নির্মাণাধীন বা পুরো ভবন ভাঙার সময় সুরক্ষামূলক ঘেরাও দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয় না। নিরাপত্তামূলক সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করে থাকেন নির্মাণশ্রমিকেরা।
গত রোববার নগরের হিলভিউ আবাসিক এলাকায় দেখা যায়, নির্মাণাধীন ভবনের নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা হয়েছে ফুটপাত ও রাস্তার ওপর। এতে মানুষের হাঁটাচলা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গাড়ি চলাচলের কারণে তাঁদের ঝুঁকিও বাড়ছে। নগরের লালদীঘি পাড় এলাকায় একটি আটতলা ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। ভবনটিতে কোনো ধরনের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কোনো ধরনের ঘেরাও ও সেফটি নেটও ছিল না। ভবনের নির্মাণকাজে যুক্ত শ্রমিকদের হেলমেট বা নিরাপত্তা রশি ছিল না। তাদের পা পিছলে বা কোনো কারণে যেকোনো মুহূর্তে নিচে পড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে শ্রমিকেরা বলেছেন, তাঁরা এভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত।
ছবি তোলার সময় ভবনের নির্মাণকাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তি বলেন, খালের নির্মাণকাজের জন্য তাঁদের ভবনের একটি অংশ ভাঙা পড়েছে। এতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন আবার বাড়তি খরচ করার সামর্থ্য নেই।
নির্মাণ খাতে দুর্ঘটনার জন্য স্থপতিদের তেমন কোনো দায় নেই বলে মনে করছেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান আশিক ইমরান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের নকশা করা পর্যন্ত স্থপতিদের ভূমিকা রয়েছে। এরপর কাজ চলাকালে প্রকল্প এলাকায় একজন প্রকৌশলী থাকেন। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য তাঁরও একটা দায় রয়েছে। তবে দেখা যায়, তিনি বললেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও মালিকপক্ষ খরচ বাঁচানোর জন্য সেসব ব্যবস্থা নেন না। তাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও মালিকপক্ষের দায় বেশি।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক এস এম শহিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় ভবনের নির্মাণকাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীরা ঠিকভাবে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন না। তবে নির্মাণকাজের সময় দুর্ঘটনার মূল দায় ভবনমালিকদের। কেননা, তাঁদের নির্দেশনা দেওয়া হলেও খরচ বাঁচানোর জন্য তারা সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেন না। এতে প্রকৌশলীদেরও কিছু করার থাকে না।
শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, নির্মাণকাজের সময় মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও এ ব্যাপারে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নজির কম। আইনি পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে গাফিলতির জন্য দায়ী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যান। তাঁরা মনে করেন, কঠোর তদারকি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে দুর্ঘটনার হার কমে আসবে।