দেশের প্রথম ছয় লেনের মধুমতী সেতু
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের নির্মিত একটি সেতু মধুমতী সেতু, যা কালনা সেতু নামেও পরিচিত। ৬৯০ মিটার দীর্ঘ ও ছয় লেনের এই সেতু বেশ বড় একটি অবকাঠামো। নড়াইল, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাকে সরাসরি সংযুক্ত করছে এই সেতু। এশিয়ান হাইওয়ে ১ সড়কের অংশ হিসেবে এর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম।
নকশা ও স্থাপত্যশৈলীতে আধুনিকতার প্রতিচ্ছবি
সওজের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের আওতায় জাইকার অর্থায়নে এ সেতু নির্মিত হয়েছে। সেতুর মধ্যখানে বসানো হয়েছে ১৫০ মিটার স্টিলের দীর্ঘ স্প্যান। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) এ স্প্যান তৈরি হয়েছে ভিয়েতনামে। ওই স্প্যানের উভয় পাশের অন্য স্প্যানগুলো পিসি গার্ডারের (কংক্রিট)। চারটি মূল লেনে দ্রুতগতির ও দুটি লেনে কম গতির যানবাহন চলাচল করে। সেতুর দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার ও প্রস্থ ২৭ দশমিক ১০ মিটার। উভয় পাশে সংযোগ সড়ক ৪ দশমিক ২৭৩ কিলোমিটার, যার প্রস্থ ৩০ দশমিক ৫০ মিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হয় ৯৫৯ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা। এটি দেশের প্রথম ৬ লেনবিশিষ্ট সেতু। নিয়েলসন-লোহসে আর্চ ডিজাইন পদ্ধতি ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে। জাপানে এই নকশা অত্যন্ত কার্যকর এবং সুপরিচিত। এই নকশার মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর ইস্পাতনির্মিত খিলান সুপারস্ট্রাকচার, যা সেতুকে একটি স্বতন্ত্র এবং দৃষ্টিনন্দন রূপ দেয়।
প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
মধুমতী সেতু নির্মাণে বিভিন্ন প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ ছিল। মধুমতী নদীর গতিপথ এবং গভীরতা নির্মাণকালে একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। নিয়মিত পাইল ক্যাপ সাধারণত ৪ মিটার নিচে স্থাপন করা হলেও নদীর মাঝখানে ৬-৮ মিটার গভীরে নির্মাণ করা হয়। অতিরিক্ত নদীভাঙনের কারণে পাইল ক্যাপের এলাকায় বালুস্ফীতি দেখা দেয়, যা নির্মাণকাজকে বাধাগ্রস্ত করে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য কোফারড্যাম ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে পানি ও মাটি ধরে রেখে কাজের স্থানকে শুষ্ক রাখতে সহায়তা করে। কোফারড্যামের ভেতরে বালুস্ফীতি বন্ধ করার জন্য সিমেন্ট গ্রাউট ব্যবহার করা হয়েছিল। ভেতরের ও বাইরের পানির স্তর সমান করার পর গ্রাউট ইনজেকশন করা হয়, যা পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে মাটিকে স্থিতিশীল করে তোলে।
নির্মাণস্থলে জোয়ার-ভাটার প্রভাব আরেকটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ ছিল। জোয়ারের সময় কর্মীদের কাজ করার সুবিধার জন্য একটি অস্থায়ী বার্জ ও পথ তৈরি করা হয়েছিল, যা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নির্মাণকাজ চালিয়ে যেতে সহায়তা করে। বাংলাদেশে প্রথমবার নিয়েলসন-লোহসে আর্চ ডিজাইনের জটিল আর্চ ডিজাইন বাস্তবায়ন করা প্রকৌশলীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। স্টিল সুপারস্ট্রাকচারের সঠিক স্থাপন, খিলান ও ডেকের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা এবং প্রতিটি অংশের সূক্ষ্ম সমন্বয় নিশ্চিত করা একটি অত্যন্ত জটিল কাজ ছিল।
ই–মেইল: [email protected]