অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করলেই অভিবাসন আইনে মামলা

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরফাইল ছবি

কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়শিবির থেকে পালিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করলে এখন থেকে তাদের যেতে হবে কারাগারে। এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে পুলিশ। আশ্রয়শিবির থেকে পালানো রোহিঙ্গা নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিবাসন আইনে মামলা করা হবে। মানব পাচার ঠেকাতে ও অবৈধ পথে ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে যাওয়া বন্ধ করতেই পুলিশ এমন পদক্ষেপ নিয়েছে।

৬ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় পাচারের সময় কক্সবাজারের টেকনাফের সমুদ্র উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয় ১২ ও ১৪ বয়সী তিনি রোহিঙ্গা শিশুকে। এ ঘটনায় এক মানব পাচারকারী ও তিন শিশুর বিরুদ্ধে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইনে মামলা হয় টেকনাফ মডেল থানায়। আদালতের মাধ্যমে মানব পাচারকারীর সঙ্গে তিন শিশুকেও কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তবে তিন শিশুকে জামিন দিয়ে আবার শিবিরে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

জানা গেছে, আশ্রয়শিবির থেকে পালানো কোনো রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইনের প্রথম মামলা এটি। এখন আশ্রয়শিবির থেকে কোনো রোহিঙ্গা পালানোর সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাদের এই আইনের মামলায় আসামি হয়ে কারাগারে যেতে হবে।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। দীর্ঘ ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে আশ্রয়শিবির থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নেওয়ার সময় অন্তত ৬০ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ শিশুকে উদ্ধার করে আশ্রয়শিবিরে ফেরত পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একই সময় টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজার সদর, মহেশখালীসহ জেলার বিভিন্ন উপকূল দিয়ে সমুদ্রপথে (ট্রলারে) মালয়েশিয়া পাচারের সময় অন্তত পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে আশ্রয়শিবিরে ফেরত পাঠায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোনো ঘটনায় উদ্ধার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ বা শিশুর বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। কারাগারে যেতে হয়নি কোনো রোহিঙ্গাকে।

যেভাবে উদ্ধার তিন শিশু
পাচারের শিকার তিন শিশুর রক্ষা পাওয়ার ঘটনা অনেকটা আকস্মিক। ৫ জানুয়ারি বিকেলে কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব পালন শেষে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার ফিরছিলেন ওই কমিটির চেয়ারম্যান ও কক্সবাজার জেলার সহকারী জজ মৈত্রী ভট্টাচার্য। ওই সময় টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের লম্বরীঘাটে পৌঁছে তিনি দেখতে পান, কয়েকজন শিশুকে একটি কাঠের নৌকায় তোলা হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে গাড়ি থামিয়ে মৈত্রী ভট্টাচার্য ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারেন, শিশুদের অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হচ্ছে। তখন তাঁর সঙ্গে থাকা পুলিশ শিশুদের উদ্ধার করে টেকনাফ থানায় খবর দেয়। টেকনাফ থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মানব পাচারকারীকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় একটি কাঠের নৌকাও জব্দ করা হয়।

কক্সবাজারের সহকারী জজ আদালতের পেশকার মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিন রোহিঙ্গা মেয়েশিশুকে নির্জন সাগরে ভাসমান একটি কাঠের নৌকায় তুলতে দেখে সহকারী জজ মৈত্রী ভট্টাচার্যের সন্দেহ হয়। তাঁর (বিচারক) আন্তরিকতায় তিন রোহিঙ্গা শিশু বিপদ থেকে রক্ষা পায়।

৬ জানুয়ারি রাতে টেকনাফ মডেল থানায় তিন রোহিঙ্গা মেয়ে শিশুসহ দুই মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন উপপরিদর্শক (এসআই) সনজীব কুমার পাল। এরপর সবাইকে আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।

পাচারের শিকার তিন শিশুই উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা। এদের দুজনের বয়স ১২ বছর ও একজনের ১৪ বছর। গ্রেপ্তার মানব পাচারকারী হলেন মহেশখালীর কালামারছড়া ইউনিয়নের আধারঘোনা গ্রামের আবদু সাত্তারের ছেলে আরিফুল ইসলাম (১৯)। মামলায় টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুরবিল গ্রামের আমির হামজার ছেলে শামশুল আলমকেও (৩৮) আসামি করা হয়। তবে তিনি পলাতক।

এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গণি প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়শিবির তিন রোহিঙ্গা মেয়েশিশুকে পাচার করে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় নেওয়া হচ্ছিল। এ ঘটনায় এক মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিবাসন আইনে মামলা হয়েছে। তবে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শিশুরা নিজেদের ইচ্ছায় বিদেশে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছে। রোহিঙ্গা সেখান থেকে পালিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানো দণ্ডনীয় অপরাধ। এ কারণে তিন শিশুর বিরুদ্ধেও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইনের ধারায় মামলা হয়েছে। তবে জামিন হওয়ায় তাদের আবার আশ্রয়শিবিরে ফেরত পাঠানো হবে।

কক্সবাজার জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক (জেল সুপার) মো. শাহ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ৬ জানুয়ারি রাতে তিন রোহিঙ্গা শিশুকে কারাগারে পাঠানো হয়। তাদের আলাদা কক্ষে রাখা হয়। আজ মঙ্গলবার বিকেলে তিন শিশুকে জামিনে মুক্তি দিয়েছেন কক্সবাজার শিশু আদালতের বিচারক। আগামীকাল বুধবার সকালে তিন রোহিঙ্গা মেয়েশিশুকে আশ্রয়শিবিরের ফেরত পাঠানো হবে। মামলার আসামি হওয়ায় শিশুদের আশ্রয়শিবিরে থেকে আদালতে হাজিরা দিতে হবে।